গলার কাঁটা অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ খাত, ৩ লাখ কোটি টাকার গচ্চা

অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের গলার কাঁটা। এখন মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ব্যয় করা পুরো অর্থই গেছে কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে। ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি নিয়েছে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার ও ইউনাইটেড।

বিদ্যুৎ সংকটকে পুঁজি করে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের একটি সিন্ডিকেট গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় করেছে ৩ লাখ কোটি টাকা। এ সময়ে শুধু রেন্টাল-কুইক-রেন্টালের আড়ালে অস্বাভাবিক দরে বিদ্যুৎ কেনার নামে লুটপাট আর পাচার করা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গুনেছে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। যার পুরোটাই হয়েছে লুটপাট। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানোর নামে রেন্টাল-কুইক-রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে।

২০১০ সালে বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। শুরুতে তিন বছরের জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হলেও পরে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। কোনোটি চলছে ১০ বছর, আবার কোনোটি এখনও চলছে।

বিশ্লেষকদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ খাতে এখনো মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ব্যয় করা পুরো অর্থই গেছে কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে। গড়ে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।

অভিযোগ আছে-কেউ কেউ পুরোনো ও ভাঙাচোরা বিদ্যুৎ প্লান্ট বসিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিয়েছে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট-ফ্যাক্টর ৮০ শতাংশের ওপরে হলেও অনেক রেন্টাল-কুইক-রেন্টাল বছরে তার সক্ষমতার ১২ শতাংশ, আবার কোনোটির মাত্র ১৬ শতাংশ উৎপাদনে ছিল। কোনো কোনো রেন্টাল-কুইক-রেন্টাল কেন্দ্রের মালিক নানা কূটকৌশলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে বছরে ২৫০ কোটি টাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় করেছে।

দ্রুততম সময়ে এমন দুর্নীতির ঘটনাকে অনেকেই রেন্টালে ‘কুইক’ লুটপাট হিসাবে অবহিত করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেন্টাল ও কুইক-রেন্টালের আর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করবে না। এরই মধ্যে স্থগিত করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়মুক্তির বিধান। এই বিধানের মাধ্যমে বিনা দরপত্রে কাজ পাওয়ার সুযোগ নিত বিশেষ একটি মহল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করেছে। এ সংক্রান্ত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে-এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে চলেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি, বরং অলস বসে ছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে কেন্দ্র মালিকদের। গত ১০ অর্থবছরে এসব রেন্টাল-কুইক-রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি।