বগুড়ার শিবগঞ্জে তিন’শ বছরের উথলী নবান্ন মেলায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি
কথিত আছে বারো মাসে তেরো পার্বণ, তেরো পার্বণের একটি পার্বণ নবান্ন। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন থেকে এ মেলা শুরু হয়। সারা দেশের সকল ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর কাছে এই নবান্ন উৎসব এখন সার্বজনীন উৎসব। ‘নবান্ন’ শস্যভিত্তিক একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রমীন শস্যোৎসব।
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গ্রামবাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। নবান্ন অর্থ নতুন অন্ন। আমন ধান কেটে নতুন অন্ন ঘরে তোলাকেই নবান্ন বলা হয়ে থাকে।
রবিবার (১৭ নভেম্বর) বগুড়ার শিবগঞ্জের তিন’শ বছরের পুরানো ঐতিহাসিক উথলী হাটে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে বসেছে ১দিনের মাছের মেলা। এ মেলায় প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ীরা বিশাল বিশাল বিভিন্ন রকমের মাছের পসরা সাজিয়ে শিশির ভেজা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাছ কেনাবেচা করেছে। এ মেলাকে আবার জামাই মেলাও বলা হয়। এ দিনে উথলী এলাকার মেয়ে জামাইদের শশুর বাড়িতে এ মেলা থেকে বড়বড় মাছ কিনে হাজির হতে হয়। এটিই এ এলাকার রেওয়াজ।
ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদার বুৎসিংহের কাছে স্থানীয় প্রজারা দাবি করেন হাট স্থাপনের। প্রজাদের আবদার শুনে জমিদার সেই সময় প্রায় ৫২ বিঘা জমি হাটের জন্য দান করেন। সেই থেকে বাংলা বছরের প্রথমে অগ্রহায়ণের উথলী বাজারে নবান্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
নবান্ন উৎসবকে ঘিরে উথলী, রথবাড়ী, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকন্দপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, গণেশপুর, রহবলসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের পাশাপাশি উপজেলা এবং জেলা থেকেও মাছ কেনার জন্য উথলী বাজারে ভিড় জমায় ক্রেতারা।
সরেজমিন দেখা যায়, ভোরবেলা থেকে মেলায় বড় বড় মাছ নিয়ে হাজির হয়েছে ব্যবসায়ীরা। দেড় শতাধিক দোকানে দুই থেকে কুড়ি কেজি ওজনের বাঘাইড়, বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, ব্রিগেড কার্প, ব্লাড কার্পসহ নানা রকমের মাছ বিক্রি হয়েছে এ মেলাশ।
মেলায় বাঘাইড় ১৫০০ টাকা কেজি, বোয়াল ১৪০০ টাকা কেজি, রুই, কাতলা ও চিতল মাছ ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।
নবান্নের মেলার মূল আকর্ষণ হলো মাছ, সেই সাথে এ মেলায় নতুন আলু,কেশর,মিষ্টি আলু, নতুন শাকসবজি ও তরকারি, বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি, রসমালাই,জিলাপি, দই, মুড়ি, মুরকি, মাটির তৈজসপত্রের দোকান বসে।
গাবতলী উপজেলার কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী কালাচাঁন বলেন, তিনি ৩ লাখ টাকার মাছ এনে ৩লক্ষ ৮০হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছি। গতবারের তুলনায় এবার মাছের দাম একটু বেশি। তবুও বিক্রি বেশ ভালো হয়েছে।
আমতলী গ্রামের মাছ বিক্রেতা আব্দুল বাকী জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে দেড়শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রতিটি মাছ বিক্রেতা অন্তত ১০ থেকে ১’শ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০/২৫ টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
বেড়াবালা গ্রামের শিক্ষক রাজিকুল ইসলাম বলেন, মেলাটি অনেক পুরনো। মেলাকে ঘিরে আশেপাশের লোকজন প্রায় কয়েক মাস আগে থেকে আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে কেনাকাটা করার জন্য। মেলায় মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দেয়া হয়। প্রতিটি বাড়িতেই মেহমান দিয়ে ভরপুর থাকে। একেকটি পরিবারের এ মেলায় মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়। যার বাড়িতে যেমন মেহমান আসে, তার বাড়িতে তেমন খরচ হয়।
বাবু নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, তার বাড়িতে অন্তত থেকে ১৫ জন আত্মীয় এসেছেন। আরও আসার কথা আছে । তিনি ১০ কেজি ওজনের রুইমাছ ৭হাজার টাকায় কিনেছেন। পাশাপাশি নতুন আলু শাক সবজি তরকারিসহ মিষ্টি, দই, রসমালাই, চিড়া ও মুড়ি কিনেছেন।
সংসার দিঘী প্রবীণ ব্যক্তি রবিন ইসলাম স্মৃতি চারণ করে বলেন, ছোটবেলায় অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শুক্রবার মসজিদে যাওয়া কোনোভাবেই মিস করিনি। কারণ নবান্ন উৎসবে গ্রামের অনেক মানুষই মসজিদে ক্ষির দিতো। নামাজ শেষে মসজিদের উঠানেই কলাপাতায় করে চেটেপুটে খেতাম। তবে এখন তা আর দেখা যায় না। কালের পরিক্রমায় তা আজ হারাতে বসেছে।
শিবগঞ্জ উথলি হাটের ইজারাদার মঞ্জুরুল হক মঞ্জু গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রতিবছর সুষ্ঠুভাবে নবান্ন উপলক্ষে একদিনের এই মেলা হয়ে আসছে। আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও গত ৪০ বছর ধরে বড় পরিসরে হচ্ছে। শুধু আশপাশের গ্রামের নয়, পুরো বগুড়া জেলার মানুষ এ মেলায় নবান্নের বাজার করতে আসে।
প্রসঙ্গতঃ
অগ্রহায়ণ মানে নতুন ধান ঘরে তোলার শুভক্ষণ। দেশের অনেক জেলাতে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে এই নবান্ন উৎসব। শুধু তাই নয় অগ্রহায়ণকে আমরা সোনার অগ্রহায়ণ মাস বলেও জানি। অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধানকে সোনার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ধান কেটে চাল প্রস্তুত করে সেই চাল দিয়ে রান্না করা হয় গুড়ের পায়েস অথবা ক্ষীর। আত্মীয়-স্বজনদের বা প্রতিবেশীদের একে অপরের আতিথেয়তা রক্ষা করা হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন