খাগড়াছড়ির শিক্ষার্থী অংসালা মারমাকে সেনাবাহিনীর আটকের ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গুইমারা উপজেলার জালিয়া পাড়া থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় এক পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক করেছে। আটক শিক্ষার্থীর নাম অংসালা মারমা (২৩)। তিনি ঢাকা সরকারি বাংলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২৩-২৪সেশনের শিক্ষার্থী।
মানিকছড়ি উপজেলা হতে রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার সময় ঢাকা সরকারি বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী অংসালা মারমাকে আটকের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি), খাগড়াছড়ি জেলা শাখা।
রোববার (২০ এপ্রিল) পিসিপি’র খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি মিঠুন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক তৃষ্ণাঙ্কর চাকমা সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে এই নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
ঘটনার বিবরনে জানা যায়, গতকাল শনিবার(১৯শে এপ্রিল ২০২৫) রাত ১০টার সময় অংসালা মারমা মানিকছড়ি হতে শান্তি গাড়ি যোগে ঢাকায় নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে ১০টা দিকে তিনি জালিয়া পাড়ায় পৌঁছলে সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গাড়িটি চেক করে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাখে। পরে তাকে আটক করে সিন্দুকছড়ি জোনে নিয়ে যায়। বর্তমানে তাকে সিন্দুকছড়ি সেনা জোনে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, ঢাকা সরকারি বাংলা কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ২০২৩-২৪শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অংসালা মারমা গতকাল (শনিবার) রাত আনুমানিক ১০টায় মানিকছড়ি হতে শান্তি গাড়ি যোগে ঢাকায় তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। রাতে সাড়ে ১০টা দিকে তিনি গুইমারার জালিয়া পাড়ায় পৌঁছলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গাড়িটি চেক করে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাখে।
এরপর তাকে আটক করে সিন্দুকছড়ি সেনাজোনে নিয়ে যায়। তাকে এখনো সেখানে আটক রাখা হয়েছে।
বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশে সব কিছু পরিবর্তন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থা আগের মতোই রয়ে গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জারি রেখে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার-আটক, নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরার পথে অংসালা মারমাকে আটকের ঘটনা তার সুষ্পষ্ট প্রমাণ দেয়।
নেতৃত্বদয় অবিলম্বে শিক্ষার্থী অংসালা মারমাকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহারপূর্বক অন্যায় ধরপাকড় ও দমন-পীড়ন বন্ধ করতে অন্তবরতীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
অপরদিকে বাংলা কলেজের আদিবাসী ছাত্র কল্যাণ সংসদের দপ্তর সম্পাদক উষাল ত্রিপুরা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে শিক্ষার্থী অংসালা মারমাকে আটকের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। রোববার(২০শে এপ্রিল) সকাল ৯টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাশিসহ নানা হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কথিত “অপহরণের” শিকার হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫শিক্ষার্থীকে উদ্ধারের নামে জেলা ব্যাপীী চলছে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান। গত ১৬ই এপ্রিল বিকেল থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান এখনো চলমান রয়েছে।
অভিযানকালে সাধারণ লোকজনের ঘরবাড়ি তল্লাশি, গাড়ি আটকিয়ে তল্লাশিসহ নানা হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বুধবার(১৬ই এপ্রিল ২০২৫) বিকেলের দিকে হঠাৎ করে পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুপের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ৫জন শিক্ষার্থীকে(যারা সবাই তাদের ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত) খাগড়াছড়ি সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে ‘অপহরণের” অভিযোগ করে এবং এর জন্য ইউপিডিএফকে দায়ি করে।
আর বিভিন্ন মিডিয়া দ্রæুত এ খবরটিকে লুফে নেয় ও ছড়িয়ে দেয়। যদিও ইউপিডিএফ শুরু থেকে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
অভিযানকালে সাধারণ জনগণের ঘরবাড়িতে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে জনগণকে নানা হয়রানি করা হচ্ছে বলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে ভুক্তভোগী লোকজন অভিযোগ করেছেন।
এদিকে, সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান সত্তে¡ও “অপহৃত” শিক্ষার্থীরা এখনো উদ্ধার না হওয়ায় জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে উক্ত ৫জন শিক্ষার্থী কী আসলে অপহরণের শিকার হয়েছেন, নাকি আত্মগোপনে রয়েছেন? কারণ তারা বাঘাইছড়িতে বিঝু উৎসবে যোগ দেয়ার নাম করে সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র ও ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে মিলিত হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র মতে, পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুপ রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ মহলের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে খাগড়াছড়িতে কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যেই শিক্ষার্থী ‘অপহরণ’ ঘটনা সাজানো হয়েছে কি-না সে প্রশ্ন উঠছে সচেতন মহলে।
সচেতন মহল বলছেন, অতীতে স্বনিভর বাজারের মতো জনসমাগম স্থানে প্রকাশ্যে দিবালোকে ব্রাশফায়ারে ছাত্র-যুব নেতাসহ ৬জন জনকে হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রীয় কোন বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। অপরাধীরা প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘুরলেও তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিন্তু এখন একটি পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় যৌথ বাহিনী যেভাবে তৎপরতা শুরু করেছে, অভিযান পরিচালনা করছে তা রীতিমত সন্দেহজনক।
অপরদিকে চবি ৫শিক্ষার্থী অপহরণের ৪দিন পরও যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। খাগড়াছড়ি শহরের সদর উপজেলার গিরিফুল এলাকা থেকে অপহৃত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা যায়নি ঘটনার ৫দিন পার হলেও।
উদ্ধারে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত শুক্রবার (১৮ই এপ্রিল) ভোর থেকে মধুপুর, পানখাইয়া পাড়া, চাবাই সড়ক ও নোয়াপাড়া এলাকায় টহল ও ব্যাপক তল্লাশি কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “অপহৃতদের উদ্ধারে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি-ঢাকা ও খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে।”
অপহরণের জন্য ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-কে দায়ী করেছে পিসিজেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপুন ত্রিপুরা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইউপিডিএফের জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা।
অপহৃত শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি শিক্ষার্থী ও তাঁদের স্বজনেরা।
অপহৃত চবি’র নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী দিব্যি চাকমার মা ভারতী চাকমা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সন্তানকে ফেরত চেয়ে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ভারতী চাকমা লিখেছেন- “প্লিজ কারো মায়ের বুক খালি না করে দোষ থাকলে উপযুক্ত শাস্তি দিন, তবুও সন্তান হারানোর বেদনা যেন কারো বুকে না লাগে। আমি হাত জোড় করছি, ফিরিয়ে দিন আমাদের সন্তানদের।
তিন দিনেও উদ্ধার হয়নি খাগড়াছড়িতে অপহৃত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের(চবি) ৫শিক্ষার্থীসহ ছয় জন। এ নিয়ে পরিবারে উদ্বেগ বাড়ছে।
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্ট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি’র) সভাপতি নিপুন ত্রিপুরা এক বিবৃতিতে রিশান চাকমাকে তাদের ছাত্র সংগঠনের চবি শাখার সদস্য দাবী করে বলেন, তারা গতকাল (মঙ্গলবার) রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বৈসাবি উৎসব শেষ করে খাগড়াছড়ি হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার কথা ছিল।
কিন্তু বাসে টিকেট না পাওয়ায় মঙ্গলবার রাতে সদর উপজেলার কুকিছড়া এলাকায় মৈত্রীময় চাকমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতযাপন করেছিল।
সকাল ৭টার গাড়িতে তাদের চট্টগ্রামে ফেরার কথা। কিন্তুু গিরিফুল এলাকা থেকে তাদেরকে জোরপূর্বক তুলে নেয়া হয়। এসময় শিক্ষার্থীদের বহনকারী টমটম চালককেও অপহরণ করা হয়। এই ঘটনার জন্য আমরা ইউপিডিএফ (প্রসীত) কে দায়ী করেন তিনি।
তবে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রæুপের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা।
এই ঘটনার জন্য আমরা ইউপিডিএফ (প্রসীত) কে দায়ী করেছেন। তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’ তবে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রæুপের জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা। তিনি বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য হচ্ছে অপহরণের সাথে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এই ধরনের প্রতিহিংসা পরায়ন রাজনীতি আমরা করি না। আমরা সবসময় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের পক্ষে। কোন মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অপহরণের ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের উপর দায় চাপাচ্ছে। ’
খাগড়াছড়ি সদর থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মো: আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, “ঘটনার পর এখনো পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল জানান, চবি’র ৫জন শিক্ষার্থীসহ ৬জনকে অপহরনের ঘটনায় পাহাড়ের আঞ্চলিক একটি সংগঠন জড়িত থাকতে পারে। আমরা মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের অবস্থান সনাক্ত করে উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল আরো জানান, অপহৃতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অভিযান চলছে। আমার অপহৃতদদের উদ্বারে সব ধরনের চেষ্টা করছে। সে সাথে বিভিন্ন সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বৈসাবি উৎসব শেষে ফেরার পথে গত বুধবার (১৬ এপ্রিল) সকালে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের ভোর সাড়ে ৬টার সময় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে সন্তু লারমা সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্য চবি শাখার রিশান চাকমাসহ ৫জন শিক্ষার্থীসহ ৬(ছয়) জনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়।
রিশান চাকমা চবি’র আন্তজাতিক সর্ম্পক বিভাগের শিক্ষার্থী।
খবরে প্রকাশ গত বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে ৫শিক্ষার্থীকে অপহরণ করা হয়। অপহৃতরা হলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য রিশন চাকমা এবং তার চার বন্ধু চারুকলা বিভাগের মৈত্রীময় চাকমা ও অলড্রিন ত্রিপুরা, নাট্যকলা বিভাগের দিব্যি চাকমা এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের লংঙি।
তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী। অপহৃতরা সকলে রাঙামাটি ও বান্দরবানের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন