খাগড়াছড়ির গুইমারায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে গুইমারা উপজেলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের যেমন কঠোর অবস্থান, ঠিক তেমনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনমনে আতঙ্ক বৃদ্ধি বেড়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রান দিতে আসা সাধারন মানুষের চেকিং, তল্লাশিতে হয়রানি মূলক চরম অমানবিক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার(৬ই অক্টোবর) জেলার গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার এলাকায় সহিংসতার প্রবারনা পুর্নিমা ৯ম দিনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা জারি রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা দিনরাত টহল অব্যাহত রেখেছে।
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ধারা প্রত্যাহারের পরও এলাকা জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার রাখা হয়েছে। রামসু বাজার প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী একটি অস্থায়ী চেকপোস্ট স্থাপন করে নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করছে, যাতে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। গুইমারা রিজিয়ন ও সিন্দুকছড়ি জোনের সেনাসদস্যরা স্থানীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন।
গুইমারা উপজেলা প্রশাসনের সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে খুব শিগগিরই পাহাড়ি ও বাঙালি দুই সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সম্প্রীতি ও পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে এক সভা আয়োজন করা হবে।
ধর্ষন ঘটনা বিচারের দাবিতে জুম্ম ছাত্র জনতার আহবানে অবরোধ চলাকালে গত ২৮শে সেপ্টেম্বর গুইমারায় ১৪৪ধারা ভঙ্গের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে টানা কয়েকদিন ধরে প্রশাসন কঠোর নজরদারি বজায় রেখেছে যাতে পুনরায় কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
এদিকে গুইমারায় সেনাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিতে জনমনে আতঙ্ক বেড়ে চলছে। জেলার গুইমারায় গত ২৮শে সেপ্টেম্বর হামলা, হত্যাকান্ড ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সেদিনের হামলায় অনেকে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমতাবস্থায় আবারো সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় এলাকার জনমনে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর এমন তৎপরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সষ্টি হতে পারে বলে সচেতন মহল আশঙ্কা করছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার(৩রা অক্টোবর) দিবাগত গভীর রাত অড়াইটার সময় গুইমারা রিজিয়নের ব্রিগেড হতে ১১টি গাড়িযোগে প্রায় ১০০জন সেনা সদস্য উপজেলার পূর্বাংশে গিয়ে বরইতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অহেতুক পাহাড়িদের অধ্যশিত এলাকায় অবস্থান নেয়। শনিবার দিনভর সেখানে অবস্থান করার পর সন্ধ্যা ৭টার সময় বরইতলী পার্শ্ববর্তী এলাকায় কুকিছড়া, সাইংগুলি পাড়া এলাকায় টহলে নামে। এতে এলাকার জনমনে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় একজন কার্বারি এ প্রতিবেদককে সেনাবাহিনীর অবস্থানের কথা জানিয়ে জনগণ আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানান।
অপরদিকে, রাত আটটায় এই রিপোর্ট লেখার সময় গুইমারা সদর থেকে পায়ে হেঁটে ৩০জনের আরো একটি সেনা দল সাইংগুলি পাড়ার দিকে আসার কথা জানিয়েছে স্থানীয়রা।
এদিকে গত ২৮শে সেপ্টেম্বর সেনা-সেটলার মিলে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাস্থল রামসু বাজারের পাশে বাংকার বানিয়ে সেনারা যুদ্ধংদেহি ভাব নিয়ে অবস্থান করছে এবং সার্বক্ষণিক ড্রোন উড়িয়ে নজর দারি করছে বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
এমন দুর্যোপপূর্ণ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর এমন ভীতিজনক তৎপরতা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ বিতরণে প্রভাব পড়তে পারে বলে সচেতন মহল মনে করছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে বা বাধা সৃষ্টি না হয় সেজন্য প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ২৮শে সেপ্টেম্বর হামলার ঘটনা পর এক পেশে পুলিশ বাদী হয়ে গুইমারা থানায় কয়েকশ’ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে হয়রানিমূলকভাবে গণগ্রেফতার করা হতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। ফলে তারা নানা ভয়-ভীতি আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।
অপরদিকে গুইমারার রামসু বাজারে সেনা-সেটলার হামলা, হত্যাকান্ড, অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে রামগড়ে হাতে লেখা পোস্টারিং করা হয়েছে। শুক্রবার(৩রা অক্টোবর ২০২৫) এই পোস্টারিং করা হয় বলে জানা গেছে। পোস্টারগুলোতে রামসু বাজার হত্যাকান্ডে জড়িত সেনাদের গ্রেফতার-শাস্তিসহ বিভিন্ন দাবি উল্লেখ রয়েছে। রামগড় উপজেলার অন্তুপাড়া, বনবিহার, পিলাক ঘাট, জিরো পয়েন্ট, লাচারী পাড়া, হাচুক পাড়া, বড়বেলছড়ি, তৈচাকমা পাড়া, যৌথখামার স্কুল, সোনাইআগা, মরা কইল্যা, চাকমা পাড়া, ছদুর খীল, নতুন বাজার, কালাপানি, গুজা পাড়াসহ বিভিন্ন দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে পোস্টার সাঁটানো দেখা গেছে।
পোস্টারগুলোতে যেসব দাবি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো-“গুইমারায় গণহত্যাকারী ব্রি. জে. সামসুদ্দীন রানার শাস্তি চাই, পাহাড়ি বিদ্বেষী ব্রি. জে. সামসুদ্দীন রানাকে প্রত্যাহার কর; রামেসু বাজারে গণহত্যার বিচার চাই; ৩জন মারমা হত্যাকারীদের গ্রেফতার কর; ৩জন মারমা হত্যাকারী সেনাদের শাস্তির চাই; মারমা কিশোরী ধর্ষকদের গ্রেফতার-শাস্তিচাই; গুইমারা থেকে সেনা ব্রিগেড প্রত্যাহার কর; রামেসু বাজারে হামলাকারী সেনা-সেটলারদের শাস্তি চাই; পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী নয়, মিশ্র বাহিনী চাই; পাহাড় থেকে সেনাশাসন তুলে নাও; রামেসু বাজারে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাও” ইত্যাদি।
ধর্ষণের অভিযোগ প্রতিবাদে সহিংসতার ঘটনায় ৮দিন পর ১৪৪ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। চলমান উদ্বুদ্ধ পরিস্থতিতে জারি করা ১৪৪ধারা ৮দিন পর প্রত্যাহার করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। শনিবার(৪ঠা অক্টোবর) রাত পৌনে ৯টার দিকে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। তবে গুরুত্বপুর্ন স্থান ও স্পশৃকাতর এলাকায় পুলিশ-আর্মড পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি তহল ও অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এতে বলা হয়, খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় এবং জনগণের জান ও মালের ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা থাকায় গত শনিবার(২৭শে সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টা থেকে পরবর্তীতে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮এর ১৪৪ধারা জারি করা হয়েছিল।
“বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮মোতাবেক ১৪৪ধারা জারির আদেশ প্রত্যাহারের চাহিদা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হতে পাওয়া গিয়েছে।
রোববার(৫ই অক্টোবর) ভোর ৬টা হতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮মোতাবেক ১৪৪ধারা জারির আদেশ প্রত্যাহার করা হল।
এর আগে সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘স্থগিত অবরোধ’ কর্মসূচি স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করে নেয় ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’। এদিকে গুইমারাতেও ১৪৪ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। গুইমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আইরস আক্তার ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮মোতাবেক ১৪৪ধারা জারি করা আদেশটি প্রত্যাহার করে নেন।
ধর্ষণের অভিযোগে আটক শয়ন শীলের বাবার দোকান ভাঙচুরের ঘটনায় খাগড়াছড়ি সদর থানায় অজ্ঞাত ৭০-৮০জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মো: আব্দুল বাতেন মৃধা।
অপদিকে “খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ২৭ ও ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কে” সেনাবাহিনীর দেয়া বিবৃতিকে ‘মিথ্যার বেসাতি ও নিজেদের অপরাধ আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা।
সোমবার(২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৫) সংবাদ মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় হামলা সম্পর্কে দেশবাসীকে যেভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, তাতে পাহাড়ের চলমান পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং হামলাকারীদের উৎসাহিত করবে।”
খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, খুন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ও গুইমারা রিজিয়নের দুই ব্রিগেড কমান্ডার, তাদের পোষ্যপুত্র ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব বাহিনী’ ও উগ্র ধর্মান্ধ সেটলারদের দায়ী করে তিনি বলেন, “সিঙ্গিনালায় মারমা কিশোরী ধর্ষণের বিচারের দাবিতে চলমান গণআন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত এবং ধর্ষকদের রক্ষা করতে পরিকল্পিতভাবে সেটলারদের লেলিয়ে দিয়ে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে।”
ঘটনা পরম্পরা তুলে ধরে অংগ্য মারমা বলেন, “গত ২৩শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরের উপকণ্ঠ সিঙ্গিনালায় অস্টম শ্রেণী পড়–য়া এক মারমা কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হন। তার প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে সাধারণ জনগণ ২৪শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে সমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশ থেকে ৩দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। কর্মসূচিগুলো হলো পরদিন(অর্থাৎ ২৫শে সেপ্টেম্বর) অর্ধদিবস খাগড়াছড়িতে সড়ক অবরোধ, ২৬শে সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশ এবং ২৫-২৭শে সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজে ক্লাশ বর্জন, যা সফলভাবে পালিত হয়।
“২৫ সেপ্টেম্বর আধাবেলা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি সফল হলে রাত সাড়ে আটটায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা পান খাইয়া পাড়া মুন্ডি দোকান থেকে ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ নেতা উক্যনু মারমাকে অপদস্থ করে টেনে হেঁচড়ে গাড়িতে তুলে খাগড়াছড়ি সেনা জোন সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। তার প্রতিবাদে শহরবাসী তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় নামলে সেনাবাহিনী দু’ঘন্টা পর রাত সাড়ে দশটার দিকে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
“২৬শে সেপ্টেম্বর শহরের চেঙ্গী স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ থেকে পরদিন ২৭শে সেপ্টেম্বরের জন্য জেলাব্যাপী পূর্ণ দিবস সড়ক অবরোধের ডাক দেয়া হয়।
“২৭শে সেপ্টেম্বরের অবরোধ বানচালের হীনউদ্দেশ্যে কতিপয় উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলারদের মাঠে নামিয়ে দেয়া হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। তারা প্রথমে খেজুরবাগান এলাকায় গায়ে পড়ে অবরোধকারীদের সাথে ঝগড়া বাঁধানোর চেষ্টা করে।
তবে তাতে সফল না হলে সেটলাররা বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে মহাজন পাড়া ও য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় তারা নৃশংসভাবে কুপিয়ে ৩পাহাড়িকে মারাত্মকভাবে জখম করে। সেটলাররা খোদ য়ংড বৌদ্ধ বিহারে হামলা করতে চাইলে জনৈক সেনা সদস্য অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেটলারদের নিবৃত্ত করেন, যা আমাদেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে।
তার শৃঙ্খলা ও পেশাদারি দায়িত্ববোধকে আমরা সম্মান জানাই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এটি অত্যন্ত বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। উক্ত সেনা সদস্যের মতো যদি বাকিরাও প্রকৃত পেশাদারি সৈনিকের মতো নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেন, তাহলে পাহাড়িরা সেটলারদের সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে রক্ষা পেত।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীর অব্যাহতভাবে পাহাড়ি বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক মনোভাব, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও সেটলারদের প্ররোচিত করে পাহাড়িদের ওপর উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষিতে ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ ২৮শে সেপ্টেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুনরায় সড়ক অবরোধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় বলে অংগ্য মারমা মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “গতকাল ২৮শে সেপ্টেম্বর সকালে অবরোধ চলাকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেরাছড়া ও ভাইবোনছড়ার বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে স্কুল ছাত্রসহ তিন জনকে আটক ও একজন পল্লী চিকিৎসক, একজন সরকারি কলেজের প্রভাষকসহ বেশ কয়েকজনকে মারধর করে।
“এরপর দুপুর ১২টার দিকে গুইমারা উপজেলায় মারমা অধ্যুষিত রামেসু বাজারে সেনাবাহিনী, তাদের পোষ্যপুত্র ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব বাহিনী’এবং উগ্রবাদী সেটলাররা মিলিতভাবে পাহাড়িদের ওপর বিনা উস্কানিতে হামলা চালায়। সেনা জওয়ান ও ঠ্যাঙাড়ে দুর্বৃত্তরা নির্বিচারে তাদের ওপর গুলি চালায়, অপরদিকে সেটলাররা দোকানপাট ও বসতবাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালানোর পর আগুন ধরিয়ে দেয়।
হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত ৩জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে বলে খাগড়াছড়ি প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহতরা হলেন ১) থোয়াইচিং মারমা(২৫) পিতার নাম হ্লাচাই মারমা, গ্রাম বটতলা পাড়া, হাফছড়ি, গুইমারা, তিনি পেশায় একজন ড্রাইভার; ২) আখ্রক মারমা(২৪) পিতার আপ্রæু মারমা, গ্রাম সাইংগুলি পাড়া, বড়পিলাক, গুইমারা; এবং ৩) আথুইপ্রæু মারমা(২৬) পিতার নাম থোয়াইহ্লাঅং মারমা, গ্রাম লিচু বাগান, হাফছড়ি, গুইমারা।
এছাড়া কয়েকজন গুরুতর আহতসহ অন্তত ৩০জন পাহাড়ি আহত হয়েছেন। হামলাকারী সেটলাররা পাহাড়িদের অন্তত ১৬টি বসতবাড়ি, ৫০টি দোকান, মাহেন্দ্র গাড়ি ১টি ও ১৬টি মোটর সাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িযে দিয়েছে।
“সেনাবাহিনী তাদের বিবৃতিতে দাবি করে ইউপিডিএফ রামেসু বাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত উঁচু পাহাড় থেকে ‘সংঘর্ষে লিপ্ত পাহাড়ি, বাঙালি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত সেনা সদস্যদের লক্ষ্য করে’ গুলি চালায়, যা সর্বৈব মিথ্যা– কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ এই ধরনের আজগুবি বক্তব্যে বিশ্বাস স্থাপন করবে না।
“সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে আরও বলা হয়: সমসাময়িক সময়ে রামসু বাজার এবং ঘরবাড়িতে ইউপিডিএফএর বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা অগ্নিসংযোগ করে এবং বাঙালিদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় লিপ্ত হয়।”
সেনাবাহিনীর এই বক্তব্যকে দুর্বল চিন্তাশক্তির অধিকারী ব্যক্তির ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফাঁদার অপপ্রয়াস অভিহিত করে অংগ্য মারমা প্রশ্ন করে বলেন, “যখন ‘ইউপিডিএফের বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা’ অগ্নিসংযোগ করছিল তখন আমাদের ’দেশপ্রেমিক’ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন?’
তাদের নাকের ডগায় কিভাবে ’ইউপিডিএফ সদস্যরা’ বাড়িতে আগুন দেয়ার সময় ও সাহস পায়? আর ইউপিডিএফ সদস্যরা গুলি করার পূর্বেই যদি পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তখন সেনা সদস্যরা কী করছিল?”
ইউপিডিএফ নেতা পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান:-১) খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়িদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা তদন্তের জন্য জাতিসংঘের অংশগ্রহণে একটি উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা।
২) সিঙ্গিনালায় কিশোরীকে গণধর্ষণের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং দ্রæুত বিচার আদালতে বিচারের মাধ্যমে সাজা প্রদান করা।
৩) গুইমারায় রামেসু বাজারে হামলায় জড়িত সেনা সদস্য, ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব বাহিনীর’ সদস্য এবং সেটলারদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান করা।
৪) উক্ত হামলায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের দ্রæুত সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।
৫) খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়া ও য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় হামলাকারী সেটলারদের গ্রেফতার এবং শাস্তি প্রদান করা। উক্ত হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
৬) গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে ও নিঃশর্তে মুক্তি দেয়া।
৭) জুম্ম ছাত্র জনতার নেতা-কর্মীসহ সাধারণ লোকজনের বাড়িতে নির্বিচারে তল্লাশি, হয়রানি ও গ্রেফতার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করা।
৮) প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ি বিদ্বেষী অপপ্রচার বন্ধ করা।
অংগ্য মারমা গতকাল ২৮শে সেপ্টেম্বর বিকালে বিজিবির কাপ্তাই ব্যাটালিয়নের চেকপোস্টে ইউপিডিএফের বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র(রাম দা) উদ্ধারের যে দাবি সেনাবাহিনীর উক্ত বিবৃতিতে করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেছেন।
এছাড়া গত বছর ১৯ ও ২০শে সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি শহরে পাহাড়িদের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে সেনাবাহিনীর উপরোক্ত বিবৃতিতে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “এসব ঘটনায় ইউপিডিএফকে দায়ি করা হলো দিনকে রাত বা সাদাকে কালো বলে প্রচার করার সামিল।”
অংগ্য মারমা বলেন, ২০২৪সালের হামলার তদন্ত হলেও তার রিপোর্ট চাপা দেয়ায় এবং অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় সেনাবাহিনীর সদস্য ও উগ্রপন্থী সেটলাররা খাগড়াছড়ি শহরে ও গুইমারার রামেসু বাজারে পুনরায় হামলা করার সাহস পেয়েছে।
“মোট কথা, মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম বাদে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডার ও সদস্যরা সেটলারদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, পাহাড়ি বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক। এ কারণে তাদের দ্বারা এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়” বলে অংগ্য মারমা মন্তব্য করেন।
তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উক্ত বিবৃতি প্রত্যাহার এবং খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় হামলার সাথে জড়িত সেনা সদস্যদের শাস্তি প্রদানের দাবি জানান।
খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায় গত রোববার আগুন দেওয়া হয় বেশ কিছু ঘরবাড়িতে। সোমবার সকালেও কিছু ঘর থেকে আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। এতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বাসা ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও মৌজা হেডম্যানের কাগজ পুড়ে তসনস হয়ে কোটি টাকার পরিমানে ক্ষতি হলেও পাশে থাকা ধানের গোলাভর্তি ধান এখনও কালো ধোওয়া উড়তে দেখা গেছে। একটি ভবনের নিচে পড়ে আছে আগুনে পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মোটর সাইকেল। সোমবার সকালে গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায় পুড়ে যাওয়া আগুনের ছায়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
জেলার গুইমারা উপজেলায় পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনায় চার দিন পর তিন মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার রাতে গুইমারা থানায় এ মামলা হয়। তিনটি মামলাতেই পুলিশ বাদী হয়েছে।
পুলিশ জানায়, তিনটি মামলার মধ্যে একটি করা হয়েছে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, সরকারি কর্মচারীদের আহত করা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে। এতে অজ্ঞাত নামা ৩০০জনকে আসামি করা হয়েছে। আরেকটি হয়েছে হত্যার অভিযোগে। এতেও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কেউ মামলা করতে রাজি হয়নি।
অন্যদিকে খাগড়াাছড়ি সদরে ১৪৪ধারা ভেঙে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও সহিংসতার অভিযোগেও একটি মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাত ৮০০জনকে আসামি করা হয়েছে।
গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মো: এনামুল হক চৌধুরী মামলার এ তথ্য বৃহস্পতিবার সকালে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, জেলা জুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন আছে। গোয়েন্দা নজরদারিও অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র সদস্যদের তহল অব্যাহত রয়েছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হয়েছে। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি মনে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তায় ১৪৪ধারা তুলে দেওয়া হয়েছে।
গত ২৪শে সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে খাগড়াছড়ি সদর সিংগীনালাতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। রাতেই তাকে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। এ ঘটনায় শয়ন শীল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর এর প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে গত শনিবার খাগড়াছড়িতে আধা বেলা অবরোধ ডাকা হয়। পরদিন থেকে তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধের ডাক দেয় সংগঠনটি। অবরোধের মধ্যেই রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয় খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারার রামেসু বাজার। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে স্থানীয় একটি পক্ষও সংঘর্ষে যোগ দেয়।
এ সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। তাঁরা তিনজনই পাহাড়ি মারমা জনগোষ্ঠীর। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০জন। রামেসু বাজার এলাকায় আগুন দেওয়া হয় প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকান পাটে।
এর মধ্যে খাগড়াছড়ির ওই কিশোরীর শারীরিক পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। তবে এ প্রতিবেদনের বিষয়ে ক্ষোভ জানান কিশোরীর বাবা।
উল্লেখ্য, গত পরশু ২৮শে সেপ্টেম্বর সিঙ্গিনালায় কিশোরী ধর্ষণের বিচারের দাবিতে আহূত শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচীতে সেনা ও সেটলাররা গুইমারায় পরিকল্পিতভাবে নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রামেসু বাজারে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এতে থোয়াইচিং মারমা(২৫), আখ্রক মারমা(২৪) ও আথুইপ্রæু মারমা(২৬) তিন জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। অর্ধ শতাধিককে গুরুতর জখম হয়, অনেকে নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে।
নিহত তিন জনের মরদেহ খাগড়াছড়িতে ময়না তদন্তের নামে ইচ্ছেকৃতভাবে হাসপাতালে ফেলে রাখা হয়। পরে রাতের অন্ধকারে(রাত ১২টার দিকে) সেনা ও পুলিশ কড়া প্রহরায় গুইমারায় পাঠিয়ে তড়িঘড়ি করে আত্মীয়স্বজনের অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ না করে দাহ করতে বাধ্য করা হয়। এতে জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন