খাগড়াছড়ি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শুভ ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ পালিত

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ৯টি উপজেলাসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শুভ ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ উৎসব উৎসব পালিত হয়েছে। শান্তি বার্তা নিয়ে যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে খাগড়াছড়িতে প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করেছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। এ উপলক্ষে সোমবার (৬ই অক্টোবর) সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে নানা ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

খাগড়াছড়ি জেলা সদরের য়ংড বৌদ্ধ বিহার, ধর্মপুর আর্যবন বিহার, গোলাবাড়ী আর্য অরণ্য ভাবনা কুঠিরসহ বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিকট পঞ্চশীল গ্রহণের পর বুদ্ধমূর্তি দান, সংঘদান, অষ্টপরিকার দান, বর্ষাবাসের চীবরদান, পিন্ডদান ও স্বধর্ম শ্রবণসহ নানান ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেন।

এ সময় ফুলপূজা ও বুদ্ধপূজার আয়োজনও করা হয়। অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করেন। এ সময় ফুলপূজা ও বুদ্ধপূজারও আয়োজন করা হয়। পূণ্যানুষ্ঠানে ভান্তেরা ধর্মদেশনা দেন এবং দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করেন।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাসের বর্ষাবাস শেষে প্রতি বছর এ প্রবারণা পূর্ণিমা পালিত হয়। এ সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যান, সাধনা, সমাধি ও প্রজ্ঞা চর্চায় নিয়োজিত থাকেন এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া নিজ বিহার ত্যাগ করেন না। প্রবারণা পূর্ণিমা পালিত ভিক্ষুসংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শেষে আসে প্রবারণা তিথি। এরপর থেকে শুরু হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাসব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসব।

বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বর্ণিল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পাহাড়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরো সুদৃঢ় করবে এমনি প্রত্যাশা সকলের।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দান আজ থেকে শুরু। পার্বত্য জেলার বৌদ্ধ বিহারগুলোয় নানা আচার আয়োজনে পালিত হয়েছে দিবসটি। বৌদ্ধপাড়ায় উৎসবমুখর আবহ। চলেছে রথ টানা ও ফানুস উড়ানোর উল্লাস।

আত্মশুদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে অশুভকে বর্জন এবং সত্য ও সুন্দরকে বরণের আয়োজন প্রবারণা। মহামতি গৌতম বুদ্ধ নির্বাণলাভের পর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে অশ্বিনী পূর্ণিমাতিথি পর্যন্ত তিন মাস প্রবারণা ব্রত পালন করেন। সেই থেকে এই তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মন্দিরে মন্দিরে ‘বর্ষাবাস’ পালন করে থাকেন।

দিনের শুরু থেকে রাঙ্গামাটির রাজ বনবিহারসহ বৌদ্ধ বিহারগুলোতে বুদ্ধ পতাকা উত্তোলন, ভিক্ষু সংঘের পিন্ডদান ও মঙ্গলসূত্র পাঠ, বুদ্ধ পূজা, পঞ্চশীল প্রার্থনাসহ বিভিন্ন দানানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দায়ক-দায়িকাদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় দেশনা প্রদান করেন বভন্তের প্রধান শিষ্য প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির।

গৌতম বুদ্ধের সম্মানে রাতে বান্দরানের আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হবে শত শত ফানুস বাতি। আর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বান্দরবান শহরের উজানীপাড়া, মধ্যমপাড়ায় আয়োজন করা হবে রথটানা উৎসবের। মারমা তরুণ-তরুণীরা নানা রঙের পোশাক পরে এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে টেনে নিয়ে যাবেন রথ। এই উৎসবকে ঘিরে আনন্দমুখর এখন বান্দরবানের মারমা পল্লীগুলো।

এটি আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। সোমবার(৬ই অক্টোবর) রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে পূর্ণিমা তিথি শুরু হয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার(৭ অক্টোবর) সকাল ৯টা ৩মিনিটে শেষ হবে। আত্মশুদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের আয়োজন এই প্রবারণা।
মহামতি গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভের পর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে অশ্বিনী পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত তিন মাস প্রবারণা ব্রত পালন করেন। সেই থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বর্ষাবাস শেষে এই দিনটি পালন করেন।

প্রতিবছর আষাঢ় মাসে প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে এক মাস ধরে দেশের প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে শুভ কঠিন চীবর দান উৎসব হয়ে থাকে।

কঠিন চীবর দান উৎসব বৌদ্ধদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর শুভ প্রবারণার মধ্য দিয়ে বিহারে বিহারে দুই দিনব্যাপী এ উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা চলে মাসজুড়ে।

‘শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দান’ উপলক্ষে গত শনিবার বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেছেন, বিশ্বে বিরাজমান অস্থিতিশীল অবস্থা দূরীকরণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এছাড়া প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, ভিক্ষু সংঘের প্রাতরাশ, মঙ্গলসূত্র পাঠ, বুদ্ধপূজা, পঞ্চশীল ও অষ্টাঙ্গ উপসথ শীলগ্রহণ, মহাসংসদান, অতিথি আপ্যায়ন, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ, আলোচনাসভা, প্রদীপ পূজা, আলোকসজ্জা, বিশ্বশান্তি কামনায় সম্মিলিত বুদ্ধোপাসনা, ফানুস উড্ডয়ন ও বুদ্ধকীর্তন।

বৌদ্ধদের মতে, এই পূর্ণিমা তিথিতে মহামতি গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর ভারতের সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন। মানবজাতির সুখ, শান্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে দিকে দিকে স্বধর্ম প্রচারের জন্য তিনি ভিক্ষু সংঘকে নির্দেশ দেন। একই দিন তাঁর তিন মাসের বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। পূজনীয় ভিক্ষু সংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শেষে আসে এ প্রবারণা তিথি। প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান।

বৌদ্ধদের মতে, আষাঢ়ের পূর্ণিমা থেকে শুরু হওয়া তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাস শেষে আসে প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রতিবছর পূর্ণিমা তিথিতে তারা এই ধর্মীয় উৎসব পালন করেন। মারমা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রবারণাকে বলেন ‘মাহা ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে’। এই দিনটি উপলক্ষে প্রার্থনা করা হয় সমগ্র মানবজাতির শান্তি ও মঙ্গল কামনায়।
বিশ্বাস করা হয়, রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম সন্ন্যাস গ্রহণের সময় চুল কেটে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্মরণে ‘চুলামনি’ উদ্দেশ্যে আকাশে ফানুস উড়িয়ে প্রবারণা উদযাপন করেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।

এই উৎসব ঘিরে পাহাড়ের প্রতিটি কোণজুড়ে তৈরি হয় প্রাণের মিলনমেলা। উৎসবে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রথযাত্রা, পিঠা তৈরি, ফানুস ওড়ানো এবং হাজারো প্রদীপ প্রজ্বালনসহ নানা আয়োজন। এবারের উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে বাঁশ দিয়ে তৈরি রাজহংসী সদৃশ একটি রথ।

মারমা তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ভাষায় উৎসব সংগীত গেয়ে রথ টেনে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার প্রদক্ষিণ করবেন এবং পরে রথ বিসর্জন দেওয়া হবে খাগড়াছড়ির মারমারা চেংগী নদী, রাংগামাটির মারমা কাপ্তাই বাধ কর্নফুলী নদী, বান্দরবান মারমা সাঙ্গু নদী, কক্্রবাজার রাখাইনরা মহাসমূদ্র সৈকতে।

ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষের য়ংন্ড বৌদ্ধবিহার প্রাংগনে ও ছোট রাজার মাঠে ইতোমধ্যে বাঁশ ও কাঠের কাঠামোয় রথ তৈরি শুরু হয়েছে। রথ ও ফানুস তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন স্থানীয় কারিগর হ্লাশৈ ও অং হ্লা শৈ মারমা।
তারা জানান, দুই সপ্তাহ ধরে কাজ করছেন তারা। এবারের মূল আকর্ষণ রাজহংসী রথ ছাড়াও থাকবে কাল্পনিক ভূত। ফানুসের মধ্যেও থাকছে নতুনত্ব—ড্রাগন, বালিশ, হাতির মতো বিভিন্ন আকৃতির ফানুস বাতি প্রবারণার দিন আকাশে উড়ানো হচ্ছে।

বাজারেও লেগেছে উৎসবের আমেজের পানখাইয়া পাড়া সড়ক বার্মিজ দোকান, পুরবী ও শৈশৈ বার্মিজ মার্কেট এখন জমজমাট। নতুন ডিজাইনের থামি ও লুঙ্গি কেনায় ব্যস্ত পাহাড়বাসী। ছোয়াইং(বিহারে আহার) এর জন্যও থামি কেনা হয়েছে।

আয়োজকরা জানিয়েছেন, এবারের প্রবারণা উৎসবে প্রায় হাজারখানেক ফানুস আকাশে ওড়ানো হয়েছে। দুপুর ৩টায় রাজগুর বৌদ্ধ বিহার থেকে রথযাত্রা শুরু হয়।
এদিকে নিরাপত্তার দিকটিও সুনিশ্চিত করতে কাজ করছে প্রশাসন। বান্দরবান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল করিম জানান, উৎসবকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা।

বৌদ্ধ ধর্মীয় লেখক সুদর্শন বড়ুয়া বলেন, আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্য তিন মাস বর্ষাব্রত শেষে প্রবারণা উৎসবের আয়োজন করা হয় বৌদ্ধ পল্লীতে। প্রবারণা অর্থ আত্মসমর্পণ ও আত্মশুদ্ধির অনুষ্ঠান। এটি ভিক্ষু সংঘের বিনয়-কর্মের নাম। বুদ্ধের সময়কালে শত শত ভিক্ষু সংঘ একই স্থানে অবস্থান করে ধর্ম ও বিনয় শিক্ষা করতেন। এ উপলক্ষে বৌদ্ধ বিহারগুলোয় ফানুস উত্তোলন করা হয়।

পরেই পাহাড়ের আকাশে দেখা যাবে রঙ-বেরঙের হাজারো ফানুস। অশুভকে বিদায় জানিয়ে শান্তির প্রার্থনায় মুখর হয়ে উঠবে পুরো পাহাড়। পালিত হয় বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। এই উৎসবকে ঘিরে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।
বিক্রেতা ও ক্রেতা উথোয়াই লেই ও হ্লানেউ মারমা জানান, এবারের প্রবারণা ঘিরে বেচাকেনা ভালোই হয়েছে।

প্রবারণা উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি চনুমং মারমা জানান, উৎসব ঘিরে নেওয়া হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এবারের প্রবারণা উৎসব সুন্দর ও উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে।

বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট কল্যান পরিষদ ও বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান ¤্রাসাথোয়াই মারমা জানান, অনাকাংখিত মারমা ৮ম শ্রেনী পড়–য়া ধর্ষিত হওয়া প্রতিবাদের ফলে সহিংসতায় নিহতদের প্রতি সম্মান সহানুভুতি ও আর্থিক সাহায্য হাত দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রবারনা পুর্নিমা যথাযথ মর্যাদায় কর্মসূচী সীমিত পরিসরে পালন করা হয়েছে।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো: শহীদুল্লাহ কাওছার বলেন প্রবারণা উৎসবকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বান্দরবান।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল জানান, সহিংস ঘটনার পর অবরোধ তুলে নেওয়ায় যথাযোগ্য মর্যাদায় ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসারে পালন করবে। তবে আইন শৃংখলা বাহিনী গুরত্বপুর্ন জায়গায় কঠোর অবস্থানে থাকবে। পার্বত্য এলাকায় প্রবারণা পূর্ণিমা ঘিরে ব্যস্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সম্প্রদায়রা।