নেত্রকোনার দুর্গাপুরে মা’শুন্য সংসারে লিটন এর জীবনযুদ্ধ

লিটনের বয়স মাত্র ১৩ বছর। এই বয়সে তার মায়ের হাতের ভাত খেয়ে, ভালোবাসা আর স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু নির্মম ভাগ্য ছিনিয়ে নিয়েছে মাকে। জীবন তাকে ঠেলে দিয়েছে কঠিন বাস্তবতার সামনে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই ঘরে মা নেই। বাবা ও ভাই কাজে বেরিয়ে যান, আর লিটন একা হাতে ভাত-তরকারি রান্না করে গুছিয়ে নেয় নিজের টিফিন। তারপর বই-খাতা কাঁধে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস গিলে হাঁটে স্কুলের পথে। বয়স ছোট হলেও দায়িত্ব যেন পাহাড়সম।
নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের বারইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা লিটন। ছয় বছর আগে মা মারা যাওয়ার পর পরিবারে আছে বাবা, ভাই ও ছোট ভাতিজা। মাকে হারানোর শোক আজও বুকের ভেতর গেঁথে আছে, তবুও বাবার আশ্রয়ে নতুন করে স্বপ্ন বুনছে সে। মায়ের কথা মনে পড়লেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে লিটন।
কান্না জড়িত কণ্ঠে লিটন বলতে শুনা যায়, আমার স্কুলে বন্ধুরার মা আইয়ে দেখলে আমার মা’র মুখটা চোখে বাইসা উঠে। আমার কষ্ট লাগে, বুকটা কেমন কইরা উঠে।
কিশোর লিটন জানায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরে যায় থাকে তা দিয়েই রান্না বসিয়ে নিজে তৈরি হয় স্কুলের জন্য। তারপর নিজে খেয়ে টিফিন নিয়ে বের হয় স্কুলের উদ্দেশ্য এরপর আবারও বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ আর রান্না, রাতে পড়তে বসা হয়।
বাবা সিদ্দিক মিয়া জানান, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। তার আশঙ্কা নতুন সংসারে সন্তান হয়তো অবহেলায় পড়ে যাবে। তাই তিনি নিজেই হয়েছেন সন্তানের ভরসা। প্রতিদিন ভোরে হাতে দা নিয়ে বের হন গাছের ডালপালা কাটার কাজে। সেই আয়ে চলে সংসারের হাট-বাজার ও ছেলের পড়াশোনার খরচ। দিন শেষে ছেলের রান্না খেতে বসলে পূরানো স্মৃতিতে চোখ ভিজে যায় তার।
সিদ্দিক মিয়া আরও বলেন, অভাব-অনটনের মাঝেও একটাই আশা ছোট ছেলেটি যেন একটু শিক্ষিত হয়। সমাজের বিত্তবান ও সরকারের সহায়তা পেলে হয়তো কিছুটা সহজ হতো বলে আশা তার।
প্রতিবেশীরাও লিটনের এই জীবনসংগ্রামকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন। প্রতিবেশী রাবিয়া খাতুন বলেন, মা মারা যাওয়ার পর এই লিটন ছিল ছোট। তারপর থেকেই অনেক কষ্টে এটুকু বড় হয়েছে। নিজেই রান্না করে আবার স্কুলে যায়। তার বাবাও সকালে কাজের খোঁজে বের হয় যায়। আমরা প্রতিবেশী চেষ্টা করি পাশে থাকতে।
দুর্গাপুর পৌর শহরের দক্ষিণ ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবার তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে লিটন। পড়াশোনায় মনোযোগী এই কিশোরের প্রশংসা করেছেন তার শিক্ষকরাও। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, মা মারা গেলে লিটন তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ত।
হঠাৎ জীবনে আসা সেই শোকে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় চার বছর অনিশ্চয়তায় ঘুরে বেড়িয়েছে সে। পরে তার বাবা ও আমাদের উৎসাহে আবার ভর্তি হয় তৃতীয় শ্রেনীতে। এখন নিয়মিত ক্লাসে আসে লিটন। লিটন খুব পরিশ্রমী ও সংগ্রামী ছেলে। আমরা তার জন্য দোয়া করি।
হয়তো একদিন এই লিটন বড় হয়ে নিজের জীবনের গল্প দিয়ে সবার জন্য হয়ে উঠবে অনুপ্রেরণা। মায়ের অভাব তাকে যেমন শিখিয়েছে সংগ্রাম করতে, তেমনি গড়ে তুলছে অদম্য মনোবল। এই জীবনযুদ্ধে যদি পায় সামান্য সহায়তা, তবে হয়তো একদিন বদলে দিতে পারবে নিজের ভাগ্যের গল্প।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন