বিরল শাক–লতার ব্যতিক্রমী মেলায় উপকূলের তারকাদের মিলনমেলা

উপকূলের লোনা জল, ঘূর্ণিঝড় আর পরিবেশঝুঁকিতে হারিয়ে যেতে বসেছে বহু দেশজ শাক–লতা ও ভেষজ উদ্ভিদ। সেই হারানো সবুজ ঐতিহ্যকে নতুন করে তুলে ধরতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার চন্ডিপুরে অনুষ্ঠিত হলো এক ব্যতিক্রমী শাক–লতা ও ভেষজ মেলা। বারসিকের আয়োজনে চন্ডিপুর দুর্গামন্দির মাঠে অনুষ্ঠিত এ মেলায় এক মঞ্চে স্থান পেয়েছে ১৩১ প্রজাতির বিরল, বিলুপ্তপ্রায় ও অচাষকৃত শাক–লতা–পাতা যা উপকূলের মানুষের ঐতিহ্য, চিকিৎসাজ্ঞান ও খাদ্যসংস্কৃতির এক মূল্যবান দলিল হয়ে উঠেছে।
সকাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে মেলা প্রাঙ্গণে ভিড় জমতে থাকে। বৃদ্ধ, নারী, শিশু, কিশোর সব বয়সী মানুষ ছুটে আসে এই অনন্য আয়োজন দেখতে। কারও হাতে খাতা–কলম, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার প্রতিটি শাকের নাম, ব্যবহার ও ঔষধিগুণ জানতে আগ্রহী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্টল থেকে স্টলে। লোনা মাটির এই উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব শাক–লতা আর আগের মতো দেখা যায় না, সেসবের এত বিস্তৃত সংগ্রহ দেখে দর্শনার্থী ও গবেষকরাও বিস্মিত।
১৩১ প্রজাতির শাক–লতা দর্শনার্থীদের বিস্ময়ে অভিভূত করেছে। মেলায় প্রদর্শিত শাক–লতার মধ্যে ছিল:হলুদের ফুল, মুক্ত ঝুরি, নিম পাতা, উলো গাছ, কেশে, ষষ্ঠী বট, খুত কৃমি, কাল কচু, ব্রাহ্মী শাক, সাদা অপরাজিতা, পিপুল শাক, থানকুনি, অর্জুন ছাল, তেলা কচু, হেলানচো, সবুজ শাপলা, সাদা শাপলা, ঢেপ, ঘেটকুল, জার্মানি লতা, ওড়ল পাতা, আলু পাতা, শান্তি শাক, পাথর কুচি, বন টমেটো, গিমে শাক, শিউলি পাতা, বন মুলা, হাতিসূর, ঘুম শাক, হেন্না গাছ, ননিয়া শাক, বিলম্ব, জবা ফুল পাতা, কুলে খাড়া, দূবা, কেশরাজ, মাধবী লতা, নোনা শাক, ভুই ওগড়া, পেপুল শাক, খুত কেউড়ে, কলমি শাক, ডুমুর, বৌনুটি, আকন্দ, নীলকণ্ঠ, তুলসি, সাদা তুলসি, আদা বরন, স্বর্ণলতা, বাসক পাতা, হাতিশুর, কালো কচু শাক, কসম গাছ, উলটকম্বল, কানসিরা, রাঙা কুচ, সেতা শাক, সিশ আকন্দ, সজিনা পাতা, কাটানোটে শাক, নোনা গড়গড়ে, অড়ল পাতা, আমরুল শাক, ঘোড়া শান্তি শাক, পেপরুল শাক, রাখাল চটকে, চির বসন্ত, কুলফি শাক, বামনহাটি, ধৃতকুমারী, রক্ত কেউটে, অর্জুন গাছ, বন ঢেঁড়স, বন তুলসি, মিশরি পাতা, কলাবতী, মোচা, কলার থোড়, শান্তি শাক, উলু গাছ, হেকড়া, শিয়ালকাঁটা, তিন বেগুন, মেরি সূর্যমুখী, ঈশানমূল, সাদা বদি, মান কচু, ধুতরা পাতা, কেয়া পাতা, নীল অপরাজিতা, মাটি ফোড়া শাক, মান্দার গাছ, বনপাটরি, অ্যালোভেরা, শষ্টি বট, বেতো শাক, শালুক, বউ নুটি, গিমের শাক, দূর্বা, আর ছোট গাছ, মনসা সেজি, দুধে শাক, নাগমণি, কালমেঘ পাতা, পাথরকুচি ও বাকোস পাতা ছিল উল্লেখযোগ্য।
এত বিস্তৃত সংগ্রহ এক জায়গায় দেখে মেলার দর্শনার্থীরা বলেন, “এগুলো আমাদের শৈশবের খাবার ছিল, এখন আর অনেকটাই নেই। আজ আবার দেখলাম মনে হলো পুরনো দিনে ফিরে গেলাম।”
অনেকে জানান, এগুলোর পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এমন মেলা নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহীদের মতে, মেলা এক নতুন পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কৃষ্ণানন্দ মুখার্জি বলেন, উপকূলীয় লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন ও বারবার ঘূর্ণিঝড়ে বহু দেশজ উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। এমন আয়োজন মানুষকে সংরক্ষণে উৎসাহিত করে এবং পরিবেশ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
অংশগ্রহণকারীরাও জানান, পূর্বপুরুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বহু উদ্ভিদ আজ বিলুপ্তপ্রায়। তাই এগুলোকে চাষাবাদে ফিরিয়ে আনা জরুরী। ১২টি স্টলের প্রতিযোগিতায় ১১৫ প্রজাতি প্রদর্শন করে প্রথম লতিকা রানী। মেলায় স্থানীয় নারীদের নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনীতে ১১৫ প্রকার শাক প্রদর্শন করে প্রথম স্থান অধিকার করেন লতিকা রানী, দ্বিতীয় হন শম্পা রানী, তৃতীয় স্থান অর্জন করেন কল্পনা রানী।
অন্যান্যদের মধ্যেও তুমুল প্রতিযোগিতা ছিল। ইতি গাইন দেখান ১০৯ প্রজাতি, নুপুর রানী ১০২, যমুনা গাইন ৯৫, মালতি রানী ৯৩, তৃষ্ণা– কনিকা জুটি ৯০, শিখা রানী ৮০, জোসনা বালা ৫৫ এবং সুন্দরী রানী দেখান ১০০ প্রজাতি। দেশজ জ্ঞান সংরক্ষণে বারসিকের এই মেলা বড় ভূমিকা রাখবে বলে জানান আয়োজকরা।
বারসিকের জানান, এই মেলা শুধু প্রদর্শনী নয় স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার, উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষা। তরুণ প্রজন্মকে দেশজ উদ্ভিদের প্রতি আগ্রহী করা। এসব লক্ষ্য পূরণেই এমন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ। চন্ডিপুরের এই সবুজ আয়োজন শুধু স্মৃতি নয় উপকূলের মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে। দর্শনার্থীদের ভাষায় “এ মেলা যতদিন থাকবে, উপকূলের স্থানীয় উদ্ভিদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে।”
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন




















