আনোয়ার ইব্রাহিম : কারাবন্দী থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী
তিন দশক ধরে যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেই স্বপ্ন পূরণের মাইলফলকে পৌঁছে গেছেন মালয়েশিয়ার প্রবীণ রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিম। বৃহস্পতিবার দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণের যাত্রাপথ বন্ধুর নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ ছিল। কখনও রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন, কখনও কারাগারে গেছেন। এক মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন, তিন দশক ধরে যে পদটিতে চোখ রাখছিলেন তিনি, সেই পদে যেতে তাকে প্রচণ্ড অধ্যবসায় করতে হয়েছে। আনোয়ার ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত।
গত শনিবারের নির্বাচনের একদিন পর আনোয়ার ইব্রাহিম তার বাসভবনের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছ থেকে একটি বিষয় শিখতে হবে— ধৈর্য, দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা এবং ধৈর্য।
আনোয়ারের প্রগতিশীল রাজনৈতিক জোট সংসদে সবচেয়ে বেশি আসন জিতলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তবে দেশটির সংসদে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান ঘটেছে বৃহস্পতিবার। মালয়েশিয়ার রাজা ৭৫ বছর বয়সী আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে এই সংকটের অবসান ঘটিয়েছেন।
বারবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আনোয়ার ইব্রাহিম দূরে থেকেছেন। বছরের পর বছর ধরে উল্লেখযোগ্য দূরত্বে থাকা সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকে প্রথমে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পরে ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে যান তিনি।
এর মাঝে সমকামিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় এক দশক জেলে কাটিয়েছেন আনোয়ার। যদিও তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অস্বীকার করেছেন তিনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম ১৯৯০ এর দশকে তার পরামর্শক থেকে শত্রু বনে যাওয়া মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রবীণ রাজনীতিক মাহাথির মোহাম্মদের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক আনোয়ারের প্রায় তিন দশকের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটেও পরিবর্তন এনেছে।
মাহাথির এক সময় আনোয়ারকে ‘বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তাকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সমকামিতার অভিযোগ এবং দেশটির আর্থিক সংকট মোকাবিলা নিয়ে মতবিরোধের জেরে মাহাথির বলেছিলেন, আনোয়ার ‘তার চরিত্রের কারণে’ দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার অযোগ্য।
দেশটির এই দুই রাজনীতিক যে জোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিলেন, ২০১৮ সালে সেই জোট ভেঙে দিয়ে মালয়েশিয়াকে নজিরবিহীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে ফেলে দেন। জোট থেকে আনোয়ার ইব্রাহিম বেরিয়ে যাওয়ায় ২২ মাসের জোট সরকারের অবসান ঘটে দেশটিতে।
জেলে এবং সংসদে থাকাকালীন বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে আনোয়ার ইব্রাহিম ধীরে ধীরে মালয়েশিয়ার দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল জোট থেকে সরে যান। ক্ষমতায় থাকাকালীন এই জোট দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়দের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল।
আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক সংস্কার বা সংশোধনের আহ্বান সারাদেশে নতুন করে জাগরণ তৈরি করে এবং এখনও তার জোটের প্রধান প্রতিশ্রুতি রয়েছে এটি। জোটটি বহু-জাতিগত এবং এতে এমন একটি দল রয়েছে, যে দলটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত-চীনা সদস্য রয়েছে। যে কারণে এই জোট রক্ষণশীল মালয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি।
প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষই জাতিগত মালয় সম্প্রদায়ের; যারা প্রধানত মুসলিম এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর। বাকিরা জাতিগত চীনা ও ভারতীয়। আনোয়ার ইব্রাহিম কয়েক দশক ধরে বহু-জাতির এই দেশটিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং এতে সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
তিনি মালয়পন্থী ইতিবাচক নীতির অপসারণ এবং পৃষ্ঠপোষক ব্যবস্থারও অবসানের আহ্বান জানান; যা এখন পর্যন্ত বারিসানের অবস্থানকে মজবুত রেখেছে।
আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেমস চাই বলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমকে সবসময় এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যিনি রাজনৈতিক লড়াইয়ে লিপ্ত সব দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন। তাকে নিয়ে উপযুক্ত যে কথাটি বলা যায়, সেটি হলো এক বিভক্ত সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি।
বন্ধু এবং শত্রু
সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগদানের আগে আনোয়ার ইব্রাহিম একজন তুখোর ইসলামিক যুবনেতা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। যা তাকে পরবর্তীতে বারিসান ন্যাশনাল জোটের নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যায়।
১৯৯৩ সালে অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি নিজের ডেপুটি হিসেবে আনোয়ারকে নিযুক্ত করেছিলেন মাহাথির। পরবর্তীতে মাহাথিরের কাছ থেকে আনোয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকট মোকাবিলার কৌশল নিয়ে তাদের মাঝে বিভাজন তৈরি হয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরে তাদের। সেই সময় মাহাথির মোহাম্মদ নেতৃত্বাধীন ইউএমএনওর দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন আনোয়ারও।
১৯৯৮ সালে আনোয়ারকে বরখাস্ত করেন মাহাথির। যা দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা করে। আর ভিন্নমত দমনে কঠোর অভিযান শুরু করে মাহাথির মোহাম্মদ নেতৃত্বাধীন সরকার। পরে আনোয়ারের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়। যদিও আনোয়ার বলেছিলেন, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে এই অভিযোগ আনা হয়েছিল।
আনোয়ার কালো কাপড়ে এক চোখ ঢেকে সমকামিতার বিচারের অভিযোগে আদালতে হাজির হন; যেটি তখন তার রাজনৈতিক দলের প্রতীক হয়ে ওঠে। কারাগারে আনোয়ারকে লাঞ্ছিত করার কথা স্বীকার করেন তৎকালীন পুলিশ প্রধান।
মাহাথির ১৯৯৮ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার সম্পর্কে বলেছিলেন, এই লোককে মালয়েশিয়ার মতো একটি দেশের নেতা হতে দেওয়া যায় না। ২০০৪ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হন আনোয়ার। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। তার দুই বছরের নেতৃত্বে সংসদে অসাধারণ সফলতা পায় তৎকালীন বিরোধীদল। এরপর ২০১৫ সালে আবারও তাকে কারাগারে যেতে হয়।
শেষ চেষ্টা?
মালয়েশিয়ার রাজনীতি আশ্চর্যজনক এক মোড় নেয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের নির্বাচনে মাহাথির এবং আনোয়ার আবারও একসাথে কাজ করতে রাজি হন। নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে বারিসান ন্যাশনালকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবির মাঝে ঐক্যমতে পৌঁছান তারা।
তখন থেকে ন্যাশনাল বারিসানের নেতা নাজিব রাজাক মালয়েশিয়ার বহুল আলোচিত ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
ওই নির্বাচনে জয়ের পর রাজকীয় আদেশে আনোয়ারকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দুই বছরের মধ্যে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন মাহাথির। কিন্তু তার আগেই তাদের জোট ভেঙে যায়। ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতার মুখে আনোয়ারকে আবারও ত্যাগ করেন মাহাথির।
মালয়েশিয়ার গত শনিবারের ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের পর দেশটিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। এই নির্বাচনে রক্ষণশীল মালয় মুসলিম জোটের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছেন আনোয়ার। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল বারিসান জোটের সাহায্য নিয়েই এই অচলাবস্থা কাটাতে হয়েছে তাকে।
এবারের নির্বাচনই শেষ কিনা জানতে চাইলে আনোয়ার ইব্রাহিম সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে রয়টার্সকে বলেন, আগামী কয়েক বছরে আমাকে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা হবে কিনা, সেটা জনগণের সিদ্ধান্ত। সূত্র: রয়টার্স, দ্য স্টার মালয়েশিয়া, বারনামা।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম
মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম। দেশটির রাজপ্রাসাদ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় তিনি শপথ নিয়েছেন। মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে শনিবার আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট ৮২টি আসনে জয় পায়।
অন্যদিকে মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের দল পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) পায় ৭৩ আসন। কোনো দলই ২২২ আসনের পার্লামেন্টে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সমর্থন দেখাতে পারেনি। দেশটিতে সরকার গঠনে ১১২ আসন নিশ্চিত করতে হয়।
৭৩ বছর বয়সি নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের জীবন রাজনৈতিক উত্থান-পতনে ভরা। ক্ষমতার খুব কাছে থেকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। বারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার হাতছানি পেলেও শেষ পর্যন্ত তা অধরা থেকেছে। তিনি ছাত্রনেতা থেকে সংস্কারপন্থি অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী থেকে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়া, বারবার কারাবরণ এবং মালয়েশিয়ার কয়েক দশকের শাসনকারী দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের প্রতিটি পর্যায়ের নায়ক।
তুখোড় এ মালয় নেতা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে সামলে ২৮ বছর আগে ১৯৯৩ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৭ সালে এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলে মাহাথিরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ তাকে বরখাস্ত করলে আনোয়ার ও তার সমর্থকরা সংস্কার আন্দোলন ‘রিফর্মাসি মুভমেন্ট’ শুরু করেন।
মাহাথির দুই দশকের বেশি সময় দেশ শাসন করে অবসর নিলে নতুন একাধিক প্রধানমন্ত্রীও আনোয়ারের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখেন। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও তার স্ত্রী ব্যাপক দুর্নীতি করলে মাহাথির দেশের অর্থনীতি রক্ষায় আবার নতুন দল করে রাজনীতিতে ফেরেন। তিনি সঙ্গে নেন সাবেক সহযোদ্ধা আনোয়ারকে। মাহাথির অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চান, অতীতের গ্লানি ভুলে আনোয়ারও সম্মতও হন মাহাথিরের প্রস্তাবে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মাহাথির ও আনোয়ারের রাজনৈতিক জোট দেশটির সাত দশকের ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করে জয় পায়। তিনি মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দেন। শর্ত থাকে, দুই বছর পর আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হবেন। ২০২০ সালে মাহাথির পূর্ব সমঝোতা অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন।
এ নিয়ে গত ফেব্র“য়ারিতে ক্ষমতাসীন জোটে ভাঙন দেখা যায়। এর জেরে মাহাথির পদত্যাগ করেন। এরপর রাজা মাহাথিরের আপত্তি উপেক্ষা করে মুহিউদ্দীন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও পদত্যাগ করেন। এসব প্রশ্নের মধ্যেই এখন জানা যাচ্ছে, মাহাথির স্থিরচিত্ত ছিলেন যাতে আনোয়ার ইব্রাহিম দেশের প্রধানমন্ত্রী না হন। তবে এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমই মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন