আবারও লাগামহীন ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ
আবারও লাগামহীন হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩শ’ ৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ২শ’ ৮৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
চলতি বছরের মার্চে করা বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর চেয়েও অনেক বেশি। কারণ খেলাপির তথ্য গোপন রাখতে ব্যাংকগুলো নানা কৌশল অনুসরণ করে। যেমন, এ সংক্রান্ত মামলায় বারবার স্টে অর্ডার বহাল রাখা, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন এবং ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে বড় অংকের খেলাপি ঋণ হিসাবের বাইরে রাখা হয়। এসব কৌশল না করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার মতো হতে পারে।
সরকারিভাবে ব্যাংক থেকে লুটপাট করা অর্থই এখন খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ।
তিনি বলেন: গত ৭/৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সরকারের লোকেরা এবং ব্যাংকগুলোর এমডি ও ডিএমডিদের যোগসাজসে ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ব্যাংকের মালিক ও এমডিরা সরকারের সাথে আঁতাত করে ব্যাংকের মধ্যে লুটতরাজ করেছে। এরপর লুটপাটের এই অর্থ দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলো বার বার পুন:তফসীল করে ঋণ হিসেবে দেখিয়েছে। সেই ঋণগুলো এখন আর পুন:তফসীল করা যাচ্ছে না। তাই খেলাপি হিসেবে দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।
ইব্রাহীম খালেদ বলেন: খেলাপির যে চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংক দেখিয়েছে তা প্রকৃত চিত্র নয়। এর সাথে অবলোপন করা ৫৫ হাজার কোটি টাকাও খেলাপি হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এই চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন: চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে যেন তারিখ বেঁধে দেয়া হয় যে, ওই সময়ের মধ্যে তারা সব ধরনের পুন:তফসীল করা ঋণের পরিমাণ দেখাতে হবে। তাহলে খেলাপি ঋণের সার্বিক চিত্র দেখা যাবে। এরপর যদি পুরানো ঋণকে পুন:তফসীলীকরণ হিসেবে দেখানো হয় তাহলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর পরামর্শ দিয়ে আরো বলেন: বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ঋণ তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে, যাদের কাজ হবে লুট করা এই অর্থ কাদের মাধ্যমে চলে গেছে, কাদের কাছে, কিভাবে গেছে তা তদন্ত করে বের করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন বলেন: ‘পুরনো গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ করছে না। কারণ তারা বুঝে গেছে যে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করলে কিছু হয় না। এই বার্তা চলে যাচ্ছে নতুন গ্রাহকদের কাছেও। এ কারণে নতুন গ্রাহকরাও ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিচ্ছে না। ফলে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপির পরিমাণ। যা এ খাতের জন্য বড় দু:সংবাদ।
তিনি বলেন: বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ বিষয়ে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দিন দিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বেই।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে খেলাপি গ্রাহকদের বিষয়ে আরো সতর্ক হতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজনে কিছু ছাড় দিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে না বরং বাড়বে বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন: সুশাসন না থাকায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের এই পরিস্থিতি।
তিনি বলেন: ‘শুধু পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণই নয়, অন্য ঋণও খেলাপি হয়ে পড়ছে। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপিঋণও অতিমাত্রায় রয়েছে। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ নাই।’
জানা গেছ, সাধারণত কোনো গ্রাহক কোনো একটি ব্যাংকের মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারে না। কিন্তু বড় ঋণগ্রহীতারা একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান খুলে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রভাব খাটিয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি ঋণ নিয়ে যায়। পরে ওই অর্থ পরিশোধ না করে ঋণ পুনর্গঠনের নামে উচ্চ আদালতে রিট করে, আবার কখনো কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ নবায়ন করে নেয়। এসব কারণে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। আর এই ব্যয় সমন্বয় করতে গিয়ে বিভিন্ন চার্জের নামে সাধারণ গ্রাহকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
সূত্র জানায়, গত বছরের শেষদিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিতকরণ ও আদায় জোরদার করায় ১ অংকে নেমে এসেছিল খেলাপি ঋণ। কিন্তু এ বছর তা আবার লাগামহীনভাবে বেড়ে ২ অংকে পৌছেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এরমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ৩ মাস আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।
তবে এর বাইরে অবলোপন করা ৫৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ মামলায় আটকে আছে। এ ঋণ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত অঙ্ক দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অবলোপন করা ঋণ মন্দঋণ হওয়ায় নীতিমালা অনুযায়ী এসব ঋণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ৩ মাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। এর পরিমাণ ৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এরপরই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৬ ব্যাংক। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বিদেশি ৯ ব্যাংকের বেড়েছে ৩৪ কোটি টাকা। তবে এই সময় বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়েনি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ করেছে ৬ লাখ ২১ হাজার ২৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩১ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০১ শতাংশ।
তবে এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ২ বিশেষায়িত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ৩ মাস আগেও এই ব্যাংকগুলোর একই চিত্র ছিল।-চ্যানেল আই অনলাইন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন