আর কত পরীক্ষা দিতে হবে নাসিরকে?
২০১১ বিশ্বকাপের পর অভিষেক তার। জিম্বাবুয়ের হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে। এরপর থেকে এক নামে পরিচিত নাসির হোসেন, ‘মিস্টার ফিনিশার’। ছয় কিংবা সাত নম্বরে ব্যাট করার সুযোগ পান। বল হাতে মাঝে-মধ্যে অফ স্পিন করে থাকেন। যদিও, মাশরাফির আমলে শুরু থেকে ‘জেনুইন’ অফ স্পিনারে পরিণত হয়েছিলেন তিনি এবং দারুণ সাফল্যও পেয়েছিলেন। মাশরাফিই তাকে দলের একমাত্র জেনুইন অফ-স্পিনার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
নাসির যখন দলে নিয়মিত ছিলেন, তখন তার জায়গাটা নিয়ে চিন্তা ছিল না বলতে গেলেই। বল হাতে ব্রেক থ্রু প্রায়ই এনে দিতে পারতেন। তার আনকোরা স্পিনে কুপোকাত হয়ে যেতেন যে কোনো ব্যাটসম্যান। ব্যাট হাতে নিয়মিত পারফরমার।
খেলেছেন ৫৯টি ওয়ানডে। এর মধ্যে ১২টিতেই ব্যাট করার সুযোগ পাননি। অথ্যাৎ ব্যাট করতে নামতে হয়নি তাকে। বাকি ৪৭টিতে সেঞ্চুরি কিংবা হাফ সেঞ্চুরির সংখ্যা নেহায়েত কম। সুতরাং, পরিসংখ্যান দিয়ে নাসিরকে কোনোভাবেই বিবেচনা করা যাবে না। তাকে বিবেচনা করতে হয় তার কার্যকরিতা দিয়ে। ৩০ থেকে ৪০- এর মধ্যে যে ইনিংসটি তিনি শেষ মুহূর্তে খেলে দিয়ে যেতেন সেটাই ছিল দলের জন্য অনেক কার্যকরি। ভক্তরা মিস্টার ফিনিশার নামটা তো আর এমনি এমনি দেননি।
ফিল্ডিংয়ের কথা বললে কিংবা বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডার বিচার করতে গেলে শুরুর দিকেই নাম চলে আসবে নাসিরের। যে কোনো পজিশনে নাসির সেরা ফিল্ডার। এখনও পর্যন্ত তার হাতে তালুবন্দী হয়েছে মোট ৩৪টি ক্যাচ। বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডারদের তালিকায় তার নাম ৬ নম্বরে। তার চেয়ে এগিয়ে যে পাঁচজন তারা তার চেয়ে ম্যাচ খেলেছেন অন্তত দ্বিগুণ বেশি।
সেই নাসির আজ টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে ব্রাত্য। দলে জায়গা পান না। গত বছর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির সময় থেকেই উপেক্ষার শিকার হতে শুরু করেন নাসির। দলের সঙ্গে থাকলেও একাদশে জায়গা মিলছিল না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও একই অবস্থা। মূল বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাছাই পর্বে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে একটি ম্যাচে সুযোগ দেয়া হয় তাকে। ব্যাট হাতে ৩ রান এবং বল হাতে ১ উইকেট- পারফরম্যান্স খারাপ তাই মূল বিশ্বকাপের আর কোনো ম্যাচে সুযোগ পাননি নাসির। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে খেলা সেটাই নাসিরের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।
গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজের সময় সমর্থকদের তুমুল দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত নাসিরকে দলে নেয়া হয় এবং দুটি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পান তিনি। তার খেলা প্রথম ম্যাচেই জয় পায় বাংলাদেশ। ২৭ রানে অপরাজিত থেকে দলের জয়ে দারুণ অবদান রাখেন। বল হাতেও নেন ১ উইকেট।
ইংল্যান্ড সিরিজের পরেই দল থেকে বাদ পড়েন নাসির। নিউজিল্যান্ড, ভারত এমনকি শ্রীলঙ্কা সিরিজেও থাকলেন উপেক্ষিত। এরই ফাঁকে বিপিএল, বিসিএল, জাতীয় লিগ কিংবা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে যান নাসির। এমনতি কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ইমার্জিং এশিয়া কাপেও ব্যাট হাতে তুলে নেন সেঞ্চুরি। ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) করলেন ডাবল সেঞ্চুরি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রথম ম্যাচেই মোহামেডানের পক্ষে সেঞ্চুরি করে বসেন তিনি। অপরাজিত থাকেন ১০৬ রানে।
একের পর এক এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর তুমুল দর্শক চাপের মুখে আয়ারল্যান্ডগামী ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে নেয়া হয় নাসিরকে। আগেই জানিয়ে দেয়া হয়, ত্রিদেশীয় সিরিজ শেষে ফেরত পাঠানো হবে নাসিরকে।
আয়ারল্যান্ডকে নেয়ার পর নাসির ছিলেন সাইড বেঞ্চের নিয়মিত সদস্য। এমনকি কোনো প্রস্তুতি ম্যাচে পর্যন্ত নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাননি মিস্টার ফিনিশার। উপেক্ষার শিকার হতে হতে শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাকে দলে নেয়া হলো। প্রথমে বল হাতে ৪৭ রান দিয়ে তিনি নেন ২ উইকেট। ব্যাট হাতে মাঠেই নামার সুযোগ পাননি।
যে কথা সে কাজ। ত্রিদেশীয় সিরিজ শেষেই দেশে ফিরে এলেন তিনি। দল গেলো ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে। টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে এতটাই ব্রাত্য যে নাসির চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাইডবেঞ্চে বসারও যোগ্য নন। সুতরাং, ১৫ জনের দলেও থাকতে পারলেন না। চলে আসতে হলো দেশে।
কথায় বলে, প্রতিভা দাবিয়ে রাখা যায় না। নাসির যে সত্যিকারের পারফরমার তা তিনি ব্যাট হাতে মাঠে নামলেই প্রমাণ দেন। প্রমাণ দিলেন শনিবারও। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তাকে দলে না রাখার যে ক্ষোভ নিজের মধ্যে পুষে রেখেছেন সেটা উগড়ে দিলেন ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামে। ১০৪ বলে সেঞ্চুরি পূরণ করার পর খেললেন ১১৩ বলে ১৩৪ রানের ইনিংস। এরপর প্রচণ্ড গরমের কাছে হার মেনে উঠে গেলেন মাঠ ছেড়ে; কিন্তু উইকেট বিলিয়ে দিলেন না কারও কাছে। শেষ পর্যন্ত গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স জিতেছে ১৭৭ রানের বিশাল ব্যবধানে।
নাসিরের এমন কার্যকরী ইনিংসের ম্যাচ অগনিত, অসংখ্য। তবুও তাকে প্রমাণ দিয়েই যেতে হবে। নাসির একের পর এক- ভালো ইনিংস খেলেন আর ক্রিকেট কর্মকর্তাদের ওপর যেন একেকটা পেরেক গেঁড়ে বসে। ক্রমাগত চাপের মধ্যে থাকেন। এমনকি খোদ বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনকেও মুখোমুখি হতে হয়, নাসির সম্পর্কে তিক্ত প্রশ্নের। সব সময়ই তার এক জবাব, ‘কার জায়গায় খেলাব নাসিরকে?’
যেন জায়গার অভাব পড়ছে। ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটিতে নাসিরকে কার জায়গায় খেলানো হয়েছিল? এর আগে যে ম্যাচগুলোতে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন- সেগুলোতে কার জায়গায় খেলানো হয়েছিল? একজন ক্রিকেটার আর কত পারফরম্যান্স করলে বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা আর মুখে কখনও বলবেন না, ‘কার জায়গায় খেলাব নাসিরকে?’ বরং নাসিরের জন্য ছয় কিংবা সাত নম্বর জায়গাটি হয়ে যাবে একেবারে নির্ধারিত।
নাসিরও আত্মবিশ্বাসী। পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। আরও দিয়ে যাবেন। তিনি হয়তো জানেন, কিছু খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তাকে দল থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে; কিন্তু ব্যাট হাতে মাঠে নামলে তো তিনি রানের ফোয়ারা বইয়ে দিচ্ছেন। বল হাতেও মোক্ষম সময়ে এনে দিচ্ছেন ব্রেক থ্রু। এ কারণেই তিনি বলে যাচ্ছেন, ‘আক্ষেপ নাই, জানি আবার ভালো খেললেই দলে ঢুকব।’
মিস্টার ফিনিশার স্বরূপে লাল-সবুজ জার্সি পরে আবার মাঠে আবির্ভূত হবেন- ভক্ত দর্শকরা এই প্রত্যাশাই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন