এক দশকেরও বেশি সময় মরছে তিস্তা, কাঁদছে কৃষক
ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২ উপজেলার কৃষকরা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি সেচ সুবিধায় ছিল। এবার রংপুর-দিনাজপুর জেলার ৭ থেকে ৮টি উপজেলাকে সেচের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এতে করে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে সেচ কাজের জন্য প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। অথচ পাওয়া যাচ্ছে বড়জোর ৭০০ কিউসেক। দিন দিন মারাত্মকভাবে পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজ থেকে ৯৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে এক কিউসেক পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পানি স্বল্পতার কারণে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে।
জানা গেছে, তিস্তার পানির সেচ সুবিধা থেকে রংপুর-দিনাজপুর জেলায় ৭-৮টি উপজেলার ৫৭ হাজার হেক্টর জমি বাদ দিয়ে এবারও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে এ দুই জেলায় প্রায় অর্ধ লাখ কৃষক সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা থেকে গত সপ্তাহ থেকে চলতি মৌসুমের বোরো সেচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে অনেক জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সেচ দিতে হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগেও ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল দুই হাজার কিউসেক। গেল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কিউসেকে।
তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, কৃষকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এবার সেচ দিতে হবে। ফলে কৃষকদের হেক্টরপ্রতি বাড়তি ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হবে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে সেচের জন্য পাওয়া যাচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ কিউসেক পানি। সামনে পানিপ্রবাহ আরও কমবে।
সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত দুই জেলার অর্ধ লাখ কৃষক
প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক, মিলছে মাত্র ৭০০
হেক্টরপ্রতি বাড়তি খরচ হবে ১৫ হাজার টাকা
পানি সংকটে কৃষিকাজে মারাত্মক বিপর্যয়
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সেবার সেচ দেওয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। পানির অভাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সেচ দেওয়া হয় মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার মাত্র ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দিনাজপুর ও রংপুরের ৫৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারী সদর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে। তবে উজানের প্রবাহ পাওয়া গেলে সেচের জমির পরিমাণ রংপুর ও দিনাজপুরে বৃদ্ধি করা হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ কিউসেক।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিস্তা নদী অববাহিকার পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর নির্ভশেীল। তিস্তায় পানির প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় সেখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা।
নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তাকে বাঁচাতে ভারতের সঙ্গে অবশ্যই পানি চুক্তি করতে হবে। তা না হলে রংপুরসহ উত্তরের জীবনযাত্রায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জানা গেছে, তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ চার হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার। এর প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন