শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা : এখনো ঝুলে আছে অন্তত ১০ মামলা

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার চার মামলায় মোট ৩৪ জনের সাজা ঘোষণা হয়েছে বিচারিক আদালতে। তবে এখনো সুরাহা হয়নি আরও অন্তত ১০টির মতো মামলার। দীর্ঘসূত্রতায় পড়া মামলাগুলোর বিচার কবে হবে, সেটাই রয়ে গেছে অনিশ্চিত।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে ১৯৮৯ সালে হত্যা চেষ্টার দুই মামলায় রবিবার নিষিদ্ধ ফ্রিডম পার্টির ১১ কর্মীর সাজা দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। এর আগে ২০ আগস্ট রায় হয় আরও দুই মামলায়। ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা বসিয়ে হত্যা চেষ্টার দুই মামলায় সেদিন ১০ জনের ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা হয় ২৩ জনের।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর বারবার আক্রমণ হয়েছে তার ওপর। তাকে ১৯ বার হত্যা চেষ্টার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে এর মধ্যে ১৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। সব ঘটনায় মামলাও হয়নি। এমনকি হামলার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার নজিরও আছে।

ঢাকা মহানগর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু আব্দুল্লাহ বলেন, আজ ধানমন্ডিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে গোপালগঞ্জের কোটায়ালীপাড়ায় হত্যাচেষ্টা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলা মামলাটি চূড়ান্ত শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি আগামী দুই মাসের মধ্যে এ মামলারও রায় ঘোষণা হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০ বার হত্যার জন্য চেষ্টা করেছে অপরাধীরা। অপরাধ করে যে পার পাওয়া যায় না এই রায় সেটার প্রমাণ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না।’

হত্যা চেষ্টা প্রায় সব সরকারের আমলেই

শেখ হাসিনার ওপর হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬০ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো বিচার পায়নি এখনো।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দুটি, ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারটি, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারটি, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে চারটি, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে পাঁচটি হত্যা চেষ্টার কথা জানা যায়।

এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একটি ঘটনায় পুলিশ মামলা করেছিল আওয়ামী লীগেরই কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। আবার ওই সরকারের আমলেই ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ উল্লেখ করে তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আরও একটি মামলায় পুলিশ সে সময় ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও পরে বাদী নারাজি দেন এবং সেই তদন্ত এখনো চলছে।

ঝুলে থাকা মামলাগুলো

আদালতে কয়েকটি মামলা দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলাও। ১৩ বছরেও এই মামলার বিচার নিম্ন আদালতে শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ আছে সরকারি দলেও। কিন্তু কবে বিচার শেষ হবে সে নিয়ে কোনো ধারণা নেই বিচার সংশ্লিষ্টদেরও।

এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে আটদলীয় জোটের জনসভার দিন ট্রাক মিছিলে পুলিশের নির্বিচারে গুলি ছুড়লে নিহত হন ২৪ জন। তাদের মধ্যে নয়জনের মতো নিহত হন শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সে সময়ের কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাকে আসামি করে মামলাটির সুরাহা হয়নি এখনো। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।

১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডির গ্রিন রোডে ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। তার গাড়িতে গুলি লাগলেও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

এই ঘটনায় করা মামলার মীমাংসা হয়নি গত ২৬ বছরেও। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে জানিয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপির প্রথম আমলে ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনমার্চ করার সময় পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে বেশ কিছু গুলি করা হয়। অসংখ্য গুলি লাগে তার বগিতে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অক্ষত থাকেন শেখ হাসিনা।

এই ঘটনায় সে সময় ঈশ্বরদী থানায় মামলা হয়। এতে ১৩০ থেকে ১৩৫ জনকে আসামি করা হয়। পরে পুলিশ পৌর বিএনপির সভাপতি মোকলেছুর রহমান বাবলু, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আজিজুর রহমান শাহীনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় আদালতে। আসামিরা সবাই জামিনে। আসামিরা বারবার সময়ের আবেদন করে শুনানি আটকে রেখেছেন।

একই সরকারের আমলে ১৯৯৫ সালের ৭ মার্চ শেখ রাসেল স্কয়ারে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়। সশস্ত্র ওই হামলা থেকে বাঁচাতে নেতাকর্মীরা তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়।

এ ঘটনায় করা মামলাটি যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু।

১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে একটি মাইক্রোবাস থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছোড়া হয়। এতে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। এই মামলটিও মীমাংসা হয়নি এখনো।

২০০১ সালে বিএনপি আবার সরকারে ফেরার পর শেখ হাসিনার ওপর একাধিক হামলা হয়। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা হয়। তখন মামলা হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অনীহায় তদন্ত আর আগায়নি।

একই বছরের ২৬ আগস্ট কলারোয়ার শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ২ সেপ্টেম্বর ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৭০-৭৫ জনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার আদালতে মামলা হয়। কিন্তু পুলিশ সে সময় ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দেন।

পরে বাদী নারাজি আবেদন দিলে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আবার তদন্ত শুরু হয়।

পরে সাতক্ষীরা পুলিশ তিনটি মামলা তদন্ত করে প্রতিটিতে ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এই মামলা তবে শেষ হবে, সে তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ বা আইনজীবীরা।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই ওই বছরের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। তখন পুলিশ উল্টো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ।

শেখ হাসিনার ওপর যত হামলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় গ্রেনেড হামলায়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় শতাধিক।

১৩ বছরেও বিচার শেষ না হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

শেখ হাসিনাকে হত্যার একাধিক চেষ্টা হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলেও। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলেমেয়েসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেইল চালাচালির খবর আসে। এতে জানানো হয়, ওই ই- মেইলটি পাঠিয়েছিলেন ইন্টার এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। ওই ঘটনায় মামলা বা বিচার কত দূর কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি।

২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন স্থলের কাছে পুঁতে রাখা হয় শক্তিশালী বোমা। বিস্ফোরণের আগেই বোমাটি উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এই ঘটনার মামলা এখনো শেষ হয়নি।

একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেটে শেখ হাসিনার নির্বাচনী জনসভাস্থলে বোমা হামলার চেষ্টা হয়। কিন্তু হামলার আগেই জনসভাস্থলের অদূরে বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গিদের দুই সদস্য নিহত হলে ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

জনসভার আগের রাতে জনসভাস্থলের কাছে একটি বাড়িকে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় দুইজন। আহত অবস্থায় আটক হয় দুইজন।

ওই মামলায় হরকাতুল জিহাদের হুজির আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা আবু সাইদ ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর সিলেট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দেন। এই মামলাও শেষ হয়নি এখনো।

২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গিদের মাধ্যমে মানববোমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৫০ জন নারী ও ১৫০ জন যুবককে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। এদের নেতৃত্বে রয়েছে ১৩ জঙ্গি দম্পতি। তবে প্রশিক্ষণরত অবস্থায়ই পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়।

২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে কারওয়ানবাজার এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা। কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণও ঘটায় তারা।