এবারও চামড়া কেনার আগ্রহ নেই
গত দুই কোরবানির ঈদে চামড়া কিনে বড় ধরনের লোকসান গুনেছেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। এবার তাই দেখেশুনে চামড়া কেনার কথা ভাবছেন তারা। এদিকে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই কোরবানির গরু জবাই শুরু হবে।
অথচ পাইকার, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে চামড়া কেনার ব্যাপারে কোনও নির্দেশনা পাচ্ছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সরকারের পক্ষ থেকে কাঁচা চামড়া রফতানি করার সিদ্ধান্তের পরও চামড়া কেনার ব্যপারে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের কোনও আগ্রহ জন্মেনি।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের মতোই এবারও চামড়ার কদর নেই। এ কারণে পাড়া-মহল্লা থেকে খুবই অল্প দামে চামড়া সংগ্রহ করবেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী লিটন সরকার বলেন, ‘পরপর গত দুইবার চামড়া কিনে ঠকেছি।’ এ কারণে এবার সবচেয়ে ভালো ও বড় মাপের চামড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনবেন। মাঝারি সাইজের চামড়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, আর ছোট গরুর চামড়ার দাম পড়বে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বলে জানান তিনি।
শুধু রাজধানীই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও কম দামে এবার কেনার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ প্রসঙ্গে পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলার মাগুড়া গ্রামের আশরাফুল আলম জানান, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় চামড়া কিনবেন। তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে এক সপ্তাহ আগে থেকে চামড়া কেনার জন্য বলা হতো। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও সেইভাবে টাকা জোগার করে রাখতো।
কিন্তু এবার ঈদ চলে এলো অথচ পাইকার, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে চামড়া কেনার ব্যাপারে কোনও নির্দেশনা নেই।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর চামড়া কিনে দাম পাইনি। এবার যাতে চামড়া কিনে বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য গড়ে আড়াইশ’ টাকায় চামড়া কিনবো।’
এদিকে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া কিনলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ঝুঁকিতে পড়বেন না।বরং ঝুঁকিতে থাকবেন ট্যানারি মালিকরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাশে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘ব্যবসায় লাভ লোকসান থাকে। এবার হয়তো মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসান করবে না। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকবেন ট্যানারি মালিকরা।’
কী কারণে ঝুঁকিতে থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষ ঘরের মধ্যে বন্দি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। অধিকাংশ মানুষ এখন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান— এই তিনটি নিয়ে ভাবছে। জুতা বা চামড়ার পণ্য ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতিতে কেউ নেই। পৃথিবীর নামি-দামি শোরুমগুলো বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করবো। কারণ, এ সময়ের সংগৃহীত চামড়া দিয়েই আমাদের সারাবছর কাজ করতে হয়। ফ্যাক্টরি চালু রাখতে হয়। শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়।’
সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয়, আর নামিদামি শো-রুম যদি না খোলে, তাহলে ট্যানারি মালিকরা লোকসানে পড়বেন। অর্থাৎ সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কেনার পরও এ বছর ট্যানারি মালিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবেন।’
তিনি বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যদি চামড়া কিনে বিকালের মধ্যে বা সন্ধার মধ্যে বিক্রি করে দিতে পারেন, তাহলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। কিন্তু যারা বেশি লাভের আশায় মধ্যরাত পর্যন্ত বসে থাকেন, তারা শেষ পর্যন্ত লাভ করতে পারেন না।’
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহার জন্য চামড়ার নির্ধারিত দর গত বছরের চেয়ে বেশ কম। এ বছর ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
অন্যদিকে খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আর্ন্তজাতিক বাজারেই চামড়ার চাহিদা নেই। এ কারণে এবার সরকারের পক্ষ থেকে চামড়ার দাম ৩০ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এই চামড়ার ওপর নির্ভরশীল গরিব ও দুস্থরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এছাড়া, এবার প্রায় ৪০ শতাংশ কম কোরবানি হবে। ফলে গরিব দুস্থদের আয় এই খাত থেকে ৪০ শতাংশ কম হবে। তবে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই খবরটাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারলে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর এবং তার আগের বছর (২০১৯ ও ২০১৮) চামড়া কিনে বড় বিপদে পড়েছিলেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ী ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় চামড়া কিনেছিলেন, তারাই বিপাকে পড়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কয়েক হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে লোকসান গুনেছেন। অনেকে চামড়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন।
ট্যানারিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই চামড়া মূলত আড়তদারের কাছে সংরক্ষিত থাকে। আড়তদার কিছু লাভ রেখে ট্যানারিতে চামড়া পৌঁছে দেন। যদিও ট্যানারি পর্যন্ত পৌঁছানোর খরচও বহন করতে হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের। ট্যানারির মালিকরা সেই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন পণ্য বানান। এসব পণ্য বিদেশেও রফতানি করা হয়।
প্রসঙ্গত, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কয়েক লাখ মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কেনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কয়েক হাজার পাইকারি ব্যবসায়ী এই চামড়া তাদের কাছ থেকে কিনে আড়তদারদের কাছে জমা রাখেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন