এমপি-মন্ত্রীরা পাত্তা দিচ্ছেন না দলের লিখিত আদেশ
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দলের এমপি-মন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করতে। একই সঙ্গে পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে বারণ করা হয়েছিল। কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না দিতেও বলা হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে। কেন্দ্রের এ নির্দেশনা পাত্তাই দিচ্ছেন না কিছু এমপি, মন্ত্রিসভার সদস্য।
বর্তমান মন্ত্রীদের পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রীরাও রয়েছেন এই তালিকায়। বাদ যাননি কেন্দ্রীয় নেতারাও। চলমান উপজেলা ভোটে অনেক জায়গায় এমপিরা পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন। তারা বিশেষ বর্ধিত সভা ডেকে একক প্রার্থী সমর্থন দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও এমপিরা দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুমকি দিচ্ছেন। প্রশাসনকে ‘অবৈধভাবে’ ব্যবহার করে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনবেন-এমন ঘোষণাও দিচ্ছেন কেউ কেউ। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ, কোথাও কোথাও বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো সময়ে অভ্যন্তরীণ খুনোখুনি আরও বাড়তে পারে। এখনই শক্তহাতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আওয়ামী লীগকে কঠিন মাশুল দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখনো সময় আছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড যদি কঠোরভাবে এমপি-মন্ত্রীদের বাড়াবাড়ি বন্ধ না করে তাহলে খুনোখুনি বাড়বে। দলের ভিতরে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
দলীয় সভানেত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন কাউকে প্রার্থী না করতে। কিন্তু অনেক এমপি-মন্ত্রী বৈঠক করে একক প্রার্থী করছেন। যেমন কুমিল্লা সদর উপজেলায় ঈদের আগেই একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। একক প্রার্থী করার কোনো কথা না। দল যে কথাগুলো বলে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না করলে সংকট আরও বাড়বে। এমপি-মন্ত্রীদের ভাই, বোন, ছেলে, বউ, আত্মীয়স্বজন প্রার্থী রয়েছেন, তাদের তো প্রার্থী থেকে বিরত রাখা যাবে না। কিন্তু বিশেষভাবে মনিটরিং করতে হবে। এটা উপজেলা-জেলাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে চলবে না। কেন্দ্রকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। তা না হলে নাটোরে যা ঘটছে (প্রার্থীকে অপহরণ করা হয়েছিল), এই ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। ফলে মাঠপর্যায়ে অস্থিরতা বাড়বে।
সামনে কঠিন মাশুল দেওয়ার আগেই এখন থেকে শক্তহাতে মনিটরিং করতে হবে। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে নাটোরের সিংড়ায় দেলোয়ার হোসেন নামে একজনকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লুৎফুল হাবীবের বিরুদ্ধে এ অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। উপজেলার ভোট ঘিরে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় দুবারের সাবেক এমপি আয়েশা ফেরদৌস ও তার ছেলে আশিক আলী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তবে চেয়ারম্যান পদে ছেলে আশিক নাকি তার মা আয়েশা থাকবেন তা নির্ভর করছে হাতিয়ার তিনবারের এমপি ও হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলীর ওপর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আশিককে রাজনৈতিকভাবে তৈরি করতে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করছেন তার বাবা মোহাম্মদ আলী। তার মাকে ডামি প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে। কোনো কারণে আশিকের মনোনয়নপত্র বাতিল হলে আয়েশা যেন নির্বাচন করতে পারেন।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তারা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার কাছে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। তবে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী। নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনের এমপি ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলিপের শ্যালক ঘোড়াশাল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি শরিফুল হককে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এমপির এ ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি সৈয়দ জাবেদ হোসেন। এমপির বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের অভিযোগে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন তিনি।
মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব ও তার পরিবারের চাপে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দেননি বলে অভিযোগ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আফসারউদ্দিন ভুইয়া। তার দাবি, জনগণের সমর্থন ছিল, কিন্তু প্রার্থী না হতে তাকে নানামুখী চাপ দেওয়া হয়েছে। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর মনোনয়নপত্র জমা দেননি। এ উপজেলায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া একমাত্র প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আনিছুজ্জামান আনিছ। তিনি সম্পর্কে এমপির আপন চাচা। বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি সাহাদারা মান্নানের ছেলে শাখাওয়াত হোসেন সজল সারিয়াকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। পাশাপাশি সোনাতলায় প্রার্থী হয়েছেন এমপির ভাই মিহাদুজ্জামান লিটন। এ নিয়ে দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলীয় সভানেত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রতীক না দিতে। কারণ, বঙ্গবন্ধুকন্যা চান অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। কিন্তু অনেক এমপি-মন্ত্রী আত্মীয়স্বজনদের একক প্রার্থী করছেন- এটা দলের নির্দেশনাকে অমান্য করা। কারণ, দলের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করতে লিখিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিলেন। সেটাও মানা হচ্ছে না। যারা মানছেন না তাদের ব্যাপারে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের য্গ্মু সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, কারও অর্জিত অধিকার বঞ্চিত করা হলে তা অমার্জনীয় অপরাধ ও নিন্দনীয়। এটা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা। নেতৃত্ব বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করা। এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনদের একক প্রার্থী করা আওয়ামী লীগের যে গণতান্ত্রিক চর্চা তা বাধার শামিল। দলের নির্দেশনা অমান্য করা মানেই আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। যারাই এই কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে দল অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন