‘ওরা আমার বাবা-মা, ওরা মুসলিম কিন্তু সন্ত্রাসী নয়’
ব্রিটিশ নারী রেবেকা ব্রাউনের পালক অভিভাবকেরা পাকিস্তানি মুসলিম। তিনি যখন তার পালক বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন তখন থেকে তাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। খবর বিবিসির।
স্কুলের বন্ধুরা রেবেকাকে প্রশ্ন করছে কেন সে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে। মূলত ধর্মের কারণে রেবেকার অভিভাবকদের সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করছে তার বন্ধুরা। রেবেকা চান আর সবাই জানুক তার অভিভাবক আর সব সাধারণ পরিবারের মতোই।
“আমি এই পরিবারের অংশ এখন” খাবার খেতে খেতে বলছিলেন রেবেকা। রেবেকা ব্রাউনের পালক মায়ের নাম শাহনাজ ও বাবার নাম মোহাম্মদ আরশাদ। ১২ বছর বয়স থেকে এই মুসলিম পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন রেবেকা, যিনি নিজেকে নাস্তিক দাবি করেন।
এখন রেবেকার বয়স ১৮, তিনি ঠিক করেছেন এই পরিবারের সঙ্গেই থাকবেন তিনি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়-এক খ্রিস্টান শিশুকে জোর করে এক মুসলিম পরিবারের ভরণপোষণের আওতায় রাখা হয়েছে।
যদিও ওই শিশুটিকে মুসলিম পরিবারের হেফাজতে দিয়েছিল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। তখন কাউন্সিল দাবি করেছিল, এই মামলাটিকে ভুলভাবে সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এক বিবৃতিতে কাউন্সিল বলে “কোনো শিশুকে ভরণপোষণের জন্য কারো হেফাজতে দেয়ার সময় তার সিদ্ধান্তও বিবেচনা করা হয়”। পরে ওই আলোচিত মামলাটির নিষ্পত্তি ঘটান বিচারক খাতুন সাপনারা। তিনি তার রায়ে ওই খ্রিস্টান শিশুটিকে তার দাদির কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ওই ঘটনার পর রেবেকা খাতুন সিদ্ধান্ত নেন এ নিয়ে তিনি তার বক্তব্য সবার সামনে তুলে ধরবেন। বিবিসির ভিক্টোরিয়া ডার্বিশায়ার প্রোগ্রামে দেয়া সাক্ষাৎকারে রেবেকা বলেন শাহনাজ ও মোহাম্মদ আরশাদ ছাড়া আর কাউকে তিনি পরিবার বলবেন না, এরা দুজনেই তার পরিবার।
এই পরিবারে থাকতে শুরু করার তিন মাস পর থেকেই রেবেকা তাদের বাবা-মা বলে ডাকতে শুরু করেন। পরিবারের সাথে আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, অনেক কিছু শিখেছেন রেবেকা। তিনি উর্দু শিখেছেন এবং তার পালক বাবা-মায়ের সাথে পাকিস্তানেও ভ্রমণ করে এসেছেন-যা দেখে তার স্কুলের বন্ধুরা খুবই অবাক হয়েছে।
একজন রেবেকাকে বলেই বসেছে “তুমি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে থাকছো”। এছাড়া আরো কয়েকজনের মন্তব্য রেবেকার অভিভাবকদের কাছে ‘বোমা বা বোমাসদৃশ বস্তু’ আছে। “অন্য সবার মতো আমিও আমার পরিবার নিয়ে থাকি” -রেবেকা বলছিলেন, বন্ধুদের এমন সব তিক্ত সব মন্তব্য শুনে কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি।
শাহনাজ বলছিলেন তিনিও কষ্ট পাবার মতো সব মন্তব্য শুনেছেন। “মানুষ ভাবে অন্য ধর্মের কারো কাছে থাকলেই সে তার অস্তিত্ব হারাবে। অনেকে প্রশ্ন করে সে কি তোমার মতো হতে পারবে বা তুমি তার মতো? সে কি পরিবারের পছন্দে বিয়ে করবে না নিজের পছন্দে?”
“আমরা চেষ্টা করছি এই শিশু যেন সবধরনের যত্ন পায়, তার লালনপালনে যেন কোনো কমতি না থাকে, সব সেরা জিনিস আমরা তাকে দিতে চাই-যেন সে বিশ্বের সেরা আদরযত্নের ভাগী হয়”।
রেবেকা যে নিজের মতো করেই তার পরিবারে বেড়ে উঠবে সেই ব্যাখ্যাও দেন শাহনাজ। “রেবেকা তার মতো করেই বেড়ে উঠবে, গড়ে উঠবে” বলছিলেন রেবেকার মা শাহনাজ।
এই পরিবার আরো দুটো সন্তান দত্তক নিয়েছে, একজন আফগান ছেলে ও আরেকজন কেনিয়ার মেয়ে। “কাউকে পালক নেয়া বা দত্তক নেয়ার মানে তার ওপর ধর্ম চাপিয়ে দেয়া নয়। কাউকে লালনপালন করা মানে তাকে তোমার মতো বানানো নয়, কিছু চাপিয়ে দেয়া নয়” বলছিলেন শাহনাজ।
তিনি জানান, রেবেকাকে ইসলাম ধর্মের কথা বলেছেন তিনি কিন্তু কখনো এ ধর্ম চাপানোর কথা ভাবেননি তারা। “আমাদের পরিবারে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। আমরা সব উৎসব পালন করি। ক্রিস্টমাসেও আমরা অনেক আনন্দ করি। কারণ এই সময়টায় এখানে বন্ধ থাকে, কোনো ধর্মের উৎসবে আমাদের কোনো বাধা নেই” বলছিলেন শাহনাজ।
শিশু দত্তক ব্যবস্থা
ব্রিটেন সরকার বলছে, ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শিশু লালনপালন বা দত্তক নেয়ার সঠিক পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে সরকারের ধারণা প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার মুসলিম শিশু শিশু লালন-পালনকেন্দ্রে আশ্রয় পায়।
কৃশ কান্দিয়াহ, একজন খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন সংস্কৃতির শিশুদের পালছেন তার নিজস্ব ‘ফস্টার কেয়ারে’। “আমাদের সমাজে অনেক শিশু আছে যাদের কোনো আশ্রয় নেই, যারা অসহায়” মি: কান্দিয়াহ জানান বাইবেল পড়ে শিশুদের দত্তক নেয়ার পরিকল্পনা আসে তার।
একজন পালক বাবা হিসেবে কোনো খ্রিস্টান ধর্মের শিশুকেই রাখবেন এমন ধারণা বাতিল করে দেন তিনি। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে আর সব ধর্মের শিশুর তার মতো করে বাঁচার অধিকার আছে বলে মনে করেন তিনি।
“মুসলিম শিশুরা যখন আসে তাদের কাছে জানি কীভাবে তাদের চাহিদা আমি পূরণ করতে পারি। আমাদের এখানে হালাল মাংস আছে, কোরান আছে। তাদের বিশ্বাসকে যেন সম্মান জানানো হয় সেটাই আমি চাই”।
কৃশ কান্দিয়াহ বলেন সমালোচকেরা ‘ফস্টার কেয়ার’ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা বাদ দিয়ে যেন এ কাজে আসেন সেটাই তিনি চান। তবে পালক পিতা-মাতার কাছে থাকলেই যে সবার অভিজ্ঞতা ভালো হবে তা নয়, কয়েকজনকে বিরূপ পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়েছে।
২৬ বছর বয়সী জেরোম হার্ভের জীবনে বাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে। হার্ভের বয়স যখন চার বছর তখন এক মুসলিম পরিবার তাকে দত্তক নেয়।
“তারা ছিল ভারতীয় মুসলিম পরিবার। আর আমি পুরোই কালচার শকের মধ্যে পড়ি। তারা যে ধরনের খাবার খেত আমি কখনোই তা খাইনি। আমি চিনতামও না কিছু। কিন্তু আমাকে সেসব খেতে বাধ্য করা হলো। তারা খ্রিস্টমাস পালন করতো না। আমি কে সেটা তারা জানার চেষ্টাও করেনি। তারা নামাজ পড়তো, তাও বুঝতামনা শুধু তাদের কপি করতাম”।
সাংস্কৃতিক প্রয়োজন
চ্যারিটি ফস্টার নেটওয়ার্কের পরিচালক ক্যাভিন উইলিয়ামস বলছেন, দত্তক নেয়া শিশু বা পালিত শিশুদের ‘সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের’ প্রতি যে সমর্থন থাকা প্রয়োজন, তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন- গত বিশ বছরে এ সংক্রান্ত ধারণা অনেক স্পষ্ট হয়েছে এবং অনেকে এটা বুঝতেও পেরেছে।
অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তারা যেন ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আসা শিশুদের সম্মান করে ও সেভাবেই নিরাপদে লালনপালন করে।
“আমরা চাই কোনো শিশু যেন একটা পরিবারে সম্পূর্ণরূপে মিশে যেতে পারে। তার ধর্ম ও সংস্কৃতিও যেন ঠিক থাকে সেদিকটাও আমরা খেয়াল রাখি-কিন্তু সবসময় এটা সম্ভব হয় না” বলেন মি: উইলিয়ামস।
তিনি চান ভবিষ্যতে যেন অনেক বেশি মুসলিম পরিবার এই কাজে সম্পৃক্ত হতে পারেন। মুসলিম অভিভাবকদের নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন রেবেকা ব্রাউন।
“একটা বইকে তার ওপরের পৃষ্ঠা নিয়ে বিবেচনা করো না। ইসলাম নিয়ে যেসব চরমন্থা খবর মিডিয়ায় আমরা দেখি, তেমনটাতো বাস্তবে নয়। খবরে ইসলাম নিয়ে সব খবরও সত্যি নয়। আর চরমপন্থার বিষয়তো আলাদা” বলছিলেন রেবেকা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন