করোনাকালে যে কারণে কমে এসেছে সিজারিয়ান
ঢাকার মগবাজার এলাকায় বসবাস করেন আফরোজা আক্তার। নিজের প্রথম সন্তানের জন্মের সময় নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসবের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন তিনি।
‘গর্ভাবস্থার ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। একদিন হঠাৎ মনে হলো পানি ভাঙার মতো। দ্রুত হাসপাতালে গেলাম। চিকিৎসক একটা টেস্ট করে বললেন পানি কমে গেছে, সিজার করতে হবে। কিন্তু আমার এখনো মনে হয় সিজারটা না করলেও পারতো।’
আবার ফরিদপুর হাসপাতালে গত মাসের শেষ দিকে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন স্কুল শিক্ষিকা রানু আক্তার। ‘৪০ সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে তাই সিজার করে ফেললো ডাক্তার,’ বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত এক দশকে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সিজারের সংখ্যা নানা অজুহাতে বেড়েই চলছিল। যদিও চিকিৎসকরা সবসময়ই বলে থাকেন যে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সিজারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না।
তবে অনেকেই অভিযোগ করেন ঝামেলা এড়াতে আবার কখনো কখনো বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো অর্থের লোভে সিজারকেই বেশি উৎসাহিত করে থাকে।
এই সিজার বা অস্ত্রোপচারের বিরুদ্ধে সন্তান জন্মদানের বিষয়টাকে নিরুৎসাহিত করতে কয়েক বছর আগে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে – স্টপ আননেসেসারি সি-সেকশন- নামে একটি প্রচারণা।
মূলত সেভ দা চিলড্রেন, ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবিসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে এটি গড়ে ওঠে।
২০১৯ সালের জুনে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারের হার ৮৩ শতাংশ, সরকারি হাসপাতালে ৩৫ শতাংশ ও এনজিও হাসপাতালে ৩৯ শতাংশ।
এবার বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর কয়েক মাস পর তারা তাদের জুলাই মাসের প্রতিবেদনে দাবি করেছেন যে, করোনা সংকটের সময়ে বাংলাদেশে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের প্রবণতা কমেছে।
আবার সরকারি হিসেবেও দেখা যাচ্ছে দেশের সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতাল ক্লিনিক মিলিয়ে গত জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সি-সেকশন বা সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার কমছে।
সরকারি হিসাবেই জানুয়ারি মাসে নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৫০ হাজার ৮৭৮টি যেখানে সিজার হয়েছে ৪৩ হাজার ৮৭৯টি।
পরে ফেব্রুয়ারি মাসে সিজার হয়েছে ৩৯ হাজার ৮৩২টি, মার্চ মাসে ৩৭ হাজার ৪১১টি, এপ্রিল মাসে ৩২ হাজার ৫৯১টি, মে মাসে ৩৩ হাজার ৮০৮টি, জুন মাসে ৩৬ হাজার ৯০টি এবং জুলাই মাসে ৩২ হাজার ১৭৩টি নরমাল ডেলিভারির বিপরীতে সিজার হয়েছে ২৬ হাজার ৮০২টি।
সরকারি হাসপাতালের চিত্র
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাবে সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সিজারের সংখ্যা খুবই কম। ফেব্রুয়ারি মাসে এসব হাসপাতালে ১৩ হাজার ৫২৩টি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে আর সিজার হয়েছে ৬১১টি। পরবর্তী মাসগুলোতে সিজারের সংখ্যা আরও কমেছে।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী মার্চ মাসে সিজার হয়েছে ৫১৪টি, এপ্রিলে ২৯৭টি, মে মাসে ২৫৫ ও জুন মাসে ১১ হাজার ৮৫৭টি স্বাভাবিক প্রসবের বিপরীতে ২৯১টি সিজার হয়েছে।
বেড়েই চলেছিল সিজারিয়ান
২০১৮ সালের তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলছিল বাংলাদেশে গত দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এতে বলা হয়েছিল, ২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সিজার বা প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার ৪ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিজারিয়ান নিয়ে এতো বিতর্ক শুরু হয়েছিল যে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তখন হাইকোর্ট সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার রোধ করতে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী কোনো দেশে মোট প্রসবের ১০-১৫ ভাগের বেশি সি-সেকশন হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এ হার ৩১ শতাংশ।
যদিও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সব প্রসব তথ্য দেশের সব জায়গা থেকে সরকারি হিসাবে আসে না। তাই প্রকৃত অবস্থায় এ হার আরও অনেক বেশি হওয়ার আশংকা আছে তাদের।
করোনায় সিজার কমছে কেন, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, করোনার সময়ে শুধু সিজার নয় বরং হাসপাতালগুলোতে নরমাল ডেলিভারি ও সিজার দুটিই কমেছে।
‘বাড়িতে প্রসব বেড়েছে ২৩%। কারণ এ সময়ে অনেকেই হাসপাতাল এড়াতে চেয়েছেন। এতে করে বাড়িতে প্রসব করাতে গিয়ে কিছু দুর্ঘটনাও যে হয়নি তা কিন্তু নয়। তাই শুধু মাত্র সিজার কমেছে এমনটি বলা যাবে না’, বলছেন ফয়সাল, যিনি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের করোনা বিষয়ক একটি উপদেষ্টা কমিটিরও একজন সদস্য।
সম্প্রতি সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের মার্চ এপ্রিলে যেখানে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২৫ হাজারের বেশি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে সেক্ষেত্রে এবছর এই দুই মাসে তাও অন্তত পাঁচ হাজার কম হয়েছে।
স্টপ আননেসেসারি সি-সেকশন ক্যাম্পেইনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে যে সিজারের সংখ্যা কমে আসার মূল কারণ হলো করোনার কারণে মানুষ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কম গিয়েছে।
‘অবস্থা জটিল না হলে অনেকেই এমনকি বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করেছে’, বলছে সংস্থাটির সাথে জড়িত একজন কর্মকর্তা।
‘রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে গেছে সিজার ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের সংখ্যা। বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন করোনার কারণে প্রসূতিরা হাসপাতালে যেতে ভয় পাওয়ায় এমনটি হচ্ছে। তবে কারণ যাই হোক অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধ তথা স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের এই ধারা অব্যাহত রাখতে, সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে,’ বলছে সংগঠনটি। -বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন