কারাগারে থাকা তিন মোড়লের ভেলকি, মামলা থেকে বাঁচার অভিনব কায়দা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দুই হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ তিন শীর্ষ আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা। অপর দুই আসামি হলেন-শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিবি) কর্মরত হলেও সেই পরিচয় গোপন করে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিষয়টি ধরা পড়লে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ডিবি থেকে জাহাঙ্গীর ছাড়াও আরও এক নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ ঘটনাকে প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা বলে মনে করছে বিএনপিসহ পুলিশের একটি পক্ষ। তারা বলছেন, স্বৈরাচারের মাথা পালিয়ে গেলেও তার লেজ রয়ে গেছে। তারা কারাগারের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসাবে তিনজনকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টায় নেমেছিল তারা। এক্ষেত্রে পরিকল্পনায় আনিসুল, সালমান ও জিয়ার মতো তিন মোড়ল ছাড়াও আরও অনেক বড় মাথা জড়িত রয়েছে। এ দোসরদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দেওয়া না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্টরা।

ডিএমপি ও ডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পুলিশসহ প্রশাসনে ধাপে ধাপে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ টিম তৈরি করেছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের ‘এ’ টিমের শীর্ষ কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও অনেকে রয়ে গেছেন। এছাড়া ‘বি’ ও ‘সি’ টিমের সদস্যরা সব জায়গায় ঘাপটি মেরে আছেন। দেশের বাইরে এবং কারাগারের ভেতরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের সঙ্গে সেসব কর্মকর্তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এ শীর্ষ তিন মোড়লও মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে কারাগার থেকে ভেলকি দেখাতে চেয়েছিলেন। ফলে ঘাপটি মেরে থাকা দোসরদের না সরানো হলে ভবিষ্যতেও এমন অবস্থা চলতে থাকবে।

ডিবি সূত্রে জানা যায়, নিউমার্কেট থানার দুটি হত্যা মামলায় আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের চেষ্টা করেন মো. জাহাঙ্গীর আরিফ। তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক উল্লেখ করে ২৩ অক্টোবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের চেষ্টা করেছিলেন। প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নেওয়ার নিয়ম থাকলেও অনুসরণ করেননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলেও তিনি এডিসি সানজিদার কথা বলেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) তিন নেতাকে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ব্যাপক মারধরের ঘটনায় সানজিদার নাম আলোচনায় এসেছিল। এই সানজিদা তাকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে ঊর্ধ্বতনদের কাছে স্বীকার করেন জাহাঙ্গীর। একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা এবং ওই নারী কর্মকর্তা এতে সংশ্লিষ্ট থাকার কথা উল্লে­খ করে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে ডিবি। বর্তমানে চাঞ্চল্যকর দুটি মামলাই নতুন কর্মকর্তা তদন্ত করছেন।

নিউমার্কেট থানা সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় সবুজকে মারধর করে এবং শাহজাহানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সবুজের চাচাতো ভাই মো. নুরনবী বাদী হয়ে একটি মামলা ও শাহজাহানের মা আয়শা বেগম অপর মামলাটি করেন। এর মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৩ আগস্ট আনিসুল ও সালমানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ১৬ আগস্ট সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতারের পর তাকেও একই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, অব্যাহতির চেষ্টার ঘটনা জানার পরপরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেছি। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর ডিবির কর্মকর্তা হওয়ায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। সানজিদার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের অন্য শাখার।

তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা। এমন চাঞ্চল্যকর মামলায় ঊর্ধ্বতনদের না জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া সানজিদার নির্দেশে কোনো কিছু করেছেন-এমন বক্তব্যও সত্য নয় বলে দাবি তার। বিষয়টি নিয়ে জানতে এডিসি সানজিদাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, হত্যা মামলা থেকে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে বাদ দিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টাই প্রমাণ করে, প্রশাসনে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। তাদের বিষদাঁত ভেঙে প্রশাসন থেকে সরিয়ে দিতে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আনিসুল-সালমান গংদের মামলা থেকে অব্যাহতির চেষ্টাই প্রমাণ করে, তারা কীভাবে কারাগারের ভেতর ও বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। এর পেছনে একটি বড় চক্র জড়িত আছে, যারা এটিকে একটি টেস্ট কেস হিসাবে নিয়েছিল। তারা সফল হলে এমন আরও অনেক ঘটনা বাস্তবায়ন করত।
সূত্র: যুগান্তর