খাগড়াছড়িতে টানা বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত পাহাড় ধসের আশংকায় তৎপর প্রশাসন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ৯টি উপজেলাতে টানা ভারী বর্ষণে বন্যা ও পাহাড় ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত তিন দিন ধরে থেমে থেমে চলা বৃষ্টিতে চেঙ্গী ও মাইনী নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, ফলে জেলার নিম্নাঞ্চল ও পাহাড়ি পাদদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে বাড়ছে আতঙ্ক। বন্যায় পানি বন্দি মানুষের দূর্ভোগ বেড়েছে, এতে দীঘিনালা-লংগদু আন্ত: প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

বুধ ও বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের চিটাইগ্যাংয়া পাড়া, নিচের বাজারসহ কয়েকটি নিচু এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার লোকজন স্থানীয় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। নদীর পানি বাড়তে থাকায় দীঘিনালা-লংগদু আন্ত: প্রধান সড়কের হেডকোয়ার্টার এলাকায় সড়ক ডুবে গেছে। এতে রাঙামাটির লংগদুর খাগড়াছড়ি সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ দুপুর থেকে বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে মেরুং বাজার প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দীঘিনালার কবাখালি ও মেরুং ইউনিয়নের বহু ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। হঠাৎ পানি বাড়তে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। বন্যায় পানি বন্দি মানুষের দূর্ভোগ বেড়েছে, দীঘিনালা-লংগদু আন্ত: প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

দুই ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্রগুলো। এর মধ্যে কবাখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেেেন্দ্র ২০টি পরিবার অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন কবাখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জ্ঞান চাকমা। তিনি আরো বলেন, পাহাড়ি ঢলে আমাদের নিচু এলাকাগুলো হঠাৎ করে তলিয়ে গেছে। তবে বৃষ্টি থামলে পানি দ্রুত নেমে যাবে বলে আমরা আশা করছি।

এদিকে মেরুং ইউনিয়নের বড় মেরুং স্টিল ব্রিজ এলাকায় দীঘিনালা-লংগদু আন্ত: প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে থাকায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সড়কপথে যাতায়াত বন্ধ হয়ে পড়েছে। যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা নৌকা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় যাতায়াত করছেন। ছোট মেরুং বাজার, চিটাগাংপাড়া ও আশপাশের গ্রামের অনেক ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা অনেকেই জরুরি জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন।

দীঘিনালা উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অখিল শিকারী জানান, দুপুরের পর হঠাৎ করে মাইনি নদীর পানি বেড়ে যায়। ফলে বড় মেরুং স্টিল ব্রিজ এলাকা দিয়ে সড়কটি তলিয়ে গেছে। যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষ নৌকা ব্যবহার করছে।

দুর্গত মানুষের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে উপজেলায় পাঁচ শতাধিক মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। আমরা তাদের জন্য পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি সহায়তার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশাসন সব ধরনের প্রস্তুুতি নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি কিছুটা কমে আসছে।

বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি দ্রুত নেমে যাবে আসা প্রকাশ করেছেন তিনি।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত পানি আরও বাড়তে পারে। ইতিমধ্যেই কৃষি জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে খাগড়াছড়ি সদরে দুপুরের পর বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। ফলে চেঙ্গি নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। তবে আকাশ এখনও মেঘাচ্ছন্ন থাকায় যেকোনো সময় বৃষ্টি আবারও বাড়তে পারে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছেন। দুর্গতদের দ্রæুত সহায়তা এবং উদ্ধার কাজ চালিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুুতি নেওয়া হয়েছে।

জেলা শহরের মুসলিম পাড়া, রাজ্যমনি পাড়া, বটতলি, গঞ্জপাড়া ব্রিজ সংলগ্ন, বাজার এলাকা, গুগড়াছড়ি এবং সড়কের বেশ কিছু অংশ ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। মাটিরাঙ্গার সাপমারা এলাকায় গাছ উপড়ে পড়ে সড়ক ও বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বিপর্যয় ঘটেছে।

পৌর শহরের শালবন, কুমিল্লা টিলা, সবুজবাগসহ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার। পাহাড় ধসের শঙ্কায় জেলা সদরসহ তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে প্রশাসন। তবে আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজনের উপস্থিতি খুবই কম।

এদিকে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলায় বন্যার পানিতে ভেঁসে এলো অজ্ঞাত এক কিশোরের লাশ। খবর পেয়ে সে লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত বুধবার(৯ই জুলাই ২০২৫) দুপুরে উপজেলার সদর ইউনিয়নের বোয়াট্টাপাড়ার চেঙ্গী নদী থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।

নদীতে মরদেহটি ভাসতে দেখেন স্থানীয় লোকজন খবর দেয় বলে জানান পুলিশ। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

মহালছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে এসেছি। মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য খাগড়াছড়ি জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, “পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে গেছে, ধসের ঝুঁকি বাড়ছে। আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে জেলা পরিষদ আর প্রশাসনের উদ্যোগে। আমরা নিম্নাঞ্চলে বসবাসরত ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য আহŸান জানাচ্ছি। আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনা খাবার আর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সবাইকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার অনুরোধ করছি।”

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনো বড় কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিসের একটি মোবাইল টিম বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখছে এবং যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুুত রয়েছে।

সিন্দুকছড়ি-জালিয়াপাড়া আন্ত: প্রধান সড়কের কয়েকটি স্থানে মাটি ধসের কারণে সড়ক যোগাযোগও হুমকির মুখে পড়েছে। এ দিন বিকেলে জেলা সদরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও নিম্নাঞ্চলে বন্যায় কবলিত স্থান পরিদর্শন করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা, পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য প্রফেসর আব্দুল লতিফ, মঞ্জিলা ঝুমাসহ জেলা পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা।

অপরদিকে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় জেলা ৯টি উপজেলাতে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নিরাপদ আশওয়ে যাওয়ার আহŸান। বর্ষা মৌসুমে টানা ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ছে পার্বত্য খাগড়াছড়িতে। এরই মধ্যে জেলা সদরের শালবনসহ কয়েকটি এলাকায় পাহাড় ধসের সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে প্রশাসন।

এমন অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে সরে যেতে আহŸান জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত মঙ্গলবার (৮ই জুলাই) বিকেলে সরেজমিনে শালবন এলাকার পাহাড় ধস প্রবণ স্থান পরিদর্শন করেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। এসময় তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সচেতন থাকার আহŸান জানান।

“প্রাণ আগে, পরে সব কিছু,” এমন সতর্কবার্তা দিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা পরিবারগুলোকে অনুরোধ করছি, বৃষ্টির সময় দয়া করে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান। আমরা সেখানে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও থাকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখেছি।”

পরিদর্শনের সময় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর প্রস্তুুতিও ঘুরে দেখেন তিনি। জানা গেছে, প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে শুকনো খাবার, শিশুদের জন্য দুধ, ওষুধ এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম। পাশাপাশি রয়েছে নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা।

এ সময় খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন চন্দ্র রায়সহ অন্যান্য কর্মকর্তা, রেডক্রিসেন্টে সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী কয়েকদিন ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের প্রতি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানানো হয়েছে।