গান্ধী-নেহরু পরিবারের রাজনীতি কি এখানেই শেষ?
ভারতের নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেয়েছে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি। অন্যদিকে বিরোধীদল কংগ্রেস এবং তার নেতা রাহুল গান্ধী – ভারতের প্রভাবশালী নেহরু-গান্ধী পরিবারের উত্তরাধিকারী – এখন পরাজিত, বিধ্বস্ত।
স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থান এই নেহরু-গান্ধী রাজনৈতিক পরিবারের। রাহুল গান্ধীর প্রপিতামহ জওহরলাল নেহরু ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তার পিতামহী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। আর পিতা রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী।
এবারের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বলা যেতো, ২০১৪ সালে কংগ্রেসের ফলাফলই ছিল সবচাইতে খারাপ। সেবার কংগ্রেস মাত্র ৪৪টি আসনে জিতেছিল, আর এবার জিতেছে ৫২টি আসনে।
কিন্তু এবার একটা বাড়তি আঘাত হলো, উত্তর প্রদেশের আমেথিতে রাহুল গান্ধী হেরে গিয়ে পার্লামেন্টে তার নিজের আসনটিও খুইয়েছেন।
অবশ্য আগামী পার্লামেন্টে রাহুল গান্ধীকে বসতে দেখা যাবে – কারণ কেরালার একটি আসন থেকেও তিনি নির্বাচন করেছিলেন এবং তাতে তিনি জিতেছেন। কিন্তু আমেথি’তে রাহুলের পরাজয়ের গুরুত্ব-তাৎপর্য অনেক।
বিবিসির গীতা পান্ডে লিখছেন, রাহুল গান্ধীর পারিবারিক পূর্বসুরীদের চিরকালের পাকা আসন এই আমেথি । সেখান থেকে তার পিতামহী ইন্দিরা, বাবা রাজীব ও মা সোনিয়া সবাই জিতেছিলেন, এমনকি রাহুল নিজেও গত ১৫ বছর ধরে ওই আসনে জিতে আসছিলেন । তাই আমেথিতে রাহুলের হেরে যাওয়া এক বিরাট অপমান।
শুধু তাই নয়, রাহুল হেরেছেন বিজেপি’র স্মৃতি ইরানীর কাছে – যিনি অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছেন।
মনে রাখা দরকার, এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস জিতবে এমনটা খুব কম লোকই ভেবেছিলেন, কিন্তু তারা অন্তত এটুকু আশা করেছিলেন যে ২০১৪-র নির্বাচনের চাইতে এবার ভালো ফল করবে কংগ্রেস। সেটা হয় নি, এবং ঠিক এটাই পার্টির ভেতরে-বাইরে সবাইকে অবাক করেছে।
রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কি প্রশ্নের মুখে?
রাহুল গান্ধী ফলাফলের পর বলেছেন, ভয় পাবার কিছু নেই, তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং শেষপর্যন্ত তারা বিজয়ী হবেন।
কিন্তু লখনৌ শহরে কংগ্রেসের অফিসে যে ক’জন কর্মী টিভির পর্দায় তাদের দলের পর্যুদস্ত হবার খবর দেখছিলেন, তাদের কাছে সে সম্ভাবনা এক মরীচিকা বলেই মনে হচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী বলছিলেন, “আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কমে গেছে, আমাদের প্রতিশ্রুতি লোকে বিশ্বাস করছে না। অন্যদিকে মি. মোদী তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন কিন্তু লোকে তার কথা এখনো বিশ্বাস করছে।”
তাকে জিজ্ঞেস করো হলো, কেন?
জবাবে তিনি বললেন, “সেটা আমরাও বুঝতে পারছি না।”
কংগ্রেসের এমন ফলাফলের পর রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে, উঠছেও। অনেক বিশ্লেষকই তার পদত্যাগ দাবি করছেন।
সমস্যা হলো, আগের মতোই এসব দাবি আসছে পার্টির বাইরে থেকে। কংগ্রেসের নেতারা এসব দাবি কানে তুলবেন না, এটাই মনে হয়।
দিল্লীর বাতাসে গুজব ভাসছে যে রাহুল গান্ধী নাকি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস রাজনীতিবিদ মণিশংকর আইয়ার বলেছেন, এ পরাজয়ের কারণ নেতৃত্ব নয়। “কংগ্রেস তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না, মি. গান্ধী পদত্যাগ করতে চাইলেও তা মানবে না।”
স্থানীয় অনেক নেতার কথায় রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের চাইতেও দলের ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচনে প্রচার-কৌশলে ভুলভ্রান্তিই ছিল কংগ্রেসের আসল সমস্যা।
ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে হেরে গেছেন রাহুল
কংগ্রেসের বিশ্লেষকরা আড়ালে ঠিকই স্বীকার করেন যে নরেন্দ্র মোদীর জনসম্মোহনী ব্যক্তিত্বের সাথে লড়াইয়ে রাহুল বরাবরই পিছিয়ে পড়ছেন।
তাদের মতে কংগ্রেসের সামনে এক বিরাট বাধা হলো ‘ব্র্যান্ড মোদী’।
তারা বলেন, নরেন্দ্র মোদী তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন কিন্তু তার কথা এখনো লোকের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে পারে।
আর রাহুল গান্ধীর সমালোচনা হচ্ছে যে তার কোন আকর্ষণী শক্তি নেই, লোকজনের সাথে তিনি সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন না, তিনি দিকভ্রান্ত এবং প্রায়ই নানা রকম রাজনৈতিক ভুল করে বসেন। মি. মোদী নিজেই অনেকবার বলেেছন যে রাহুল গান্ধী এ অবস্থানে এসেছেন নিজের যোগ্যতায় নয়, বরং পারিবারিক যোগাযোগের কারণে।
কংগ্রেসের সদস্যরাও জনান্তিকে বলেন, রাহুল একজন সহজ-সরল মানুষ, প্রতিপক্ষের যে কৌশলী ধূর্ততা – তা তার নেই।
গান্ধী পরিবারের বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য এখন সুদূর অতীতের বিষয়
নেহরু-গান্ধী পরিবার থেকে ভারতের তিন জন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন ঠিকই – কিন্তু সে পরিবারের ঐতিহ্য এখন কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে।
এ যুগের ভারতের উচ্চাভিলাষী তরুণদের কাছে জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধী আর প্রাসঙ্গিক নন, তাদের অবদান অনেক দূর অতীতের ইতিহাস মাত্র।
একালের প্রজন্মের কাছে বরং কংগ্রেসের ২০০৪-২০১৪ শাসনকালের বিতর্ক-দুর্নীতিই প্রধান। এটা স্পষ্ট যে এই প্রজন্মের কাছে রাহুল গান্ধী তার ‘ভিশন’ বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
কংগ্রেসের নেতারা তাদের এই বিপর্যয়ের জন্য রাহুল গান্ধীকে দোষ দিতে চান না। তবে একজন বলেছেন, রাহুল গান্ধীর একজন ‘অমিত শাহ’ দরকার – যিনি তার জন্য নির্বাচনী বিজয়ের একটা কৌশল তৈরি করতে পারবেন। যেমনটা বিজেপির প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র মোদীর জন্য করেছেন।
আসলে, সাম্প্রতিক কালে রাহুল গান্ধীর ইমেজ আগের চাইতে খানিকটা উন্নত হচ্ছিল বলেই বলা যায়। ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তার বোন প্রিয়াংকা গান্ধী উত্তর প্রদেশের প্রচারণায় যোগ দেন – তখন অনেকে মনে করেছিলেন হয়তো এই দুই গান্ধী কিছু ঘটিয়ে ফেলতেও পারেন।
অনেক দিন ধরেই কিছু কংগ্রেস সমর্থক বিশ্বাস করতেন যে রাহুল নয়, বরং প্রিয়াংকাই হচ্ছেন সেই ‘গান্ধী’ – যিনি এ পরিবারের বংশানুক্রমিক রাজনীতিকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু প্রিয়াংকা গান্ধী সে দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না।
মনে করা হয় রাহুল ও প্রিয়াংকার সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ। তাই এখন ভাইকে হটিয়ে দেবার কোন পরিকল্পনায় বোন অংশ নেবেন এমন সম্ভাবনা কম. তবে প্রিয়াংকা হয়তো আগামীতে একটা বৃহত্তর ভুমিকা নিতে পারেন।
কংগ্রেস কি আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে?
শেষ পর্যন্ত এটাই বলা হচ্ছে যে, কংগ্রেস পার্টির ভারতকে যেমন করে গড়তে চায় – ‘সেই ভিশন’ ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু মি. মোদী যেভাবে ভারতের রাজনৈতিক হৃৎস্পন্দন ধরতে পেরেছেন এবং তা প্রভাবিত করেছেন – কংগ্রেস সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের আত্মানুসন্ধান করতে হবে, কেন এটা ঘটলো তা বের করতে হবে, বলছেন দলটির নেতারা।
তারা আরো বলছেন, নির্বাচনের ফল যতই খারাপ হোক, রাহুল গান্ধীর পাশে তারা থাকবেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, শুধু রাহুল নয় আরো অনেক নেতাই তো হেরে গেছেন। সব নির্বাচনেই এটা হয়, অনেকে জেতেন, অনেকে হারেন।
এরা আরো মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৮৪ সালে এই বিজেপিই মাত্র দু’টি আসন পেয়েছিল। “তারা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখানে আসতে পারে, তাহলে আমরাও পারবো।”
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন