গ্রেনেড হামলা : ধামাচাপা দিতে জোট সরকারের যত নাটক
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ধামাচাপা দিতে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার নানা কৌশল নিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল আলামত নষ্ট করা, ভুয়া জবানবন্দি দেয়া, বিচারিক তদন্তের নামে কাল্পনিক কাহিনি নির্মাণ, আওয়ামী লীগের ওপরই দোষ চাপান। কিন্তু পরে সব কিছুই ভুয়া প্রমাণ হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারায় ২৪ নেতা-কর্মী। বলতে গেলে অলৌকিকভাবেই বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
এই হামলার পর পর সরকার বেশ বেকায়দায় পড়লেও তিন দিনের মাথায় মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করে বিএনপি নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের সহানুভূতি পেতে এই নাটক সাজিয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনা ভ্যানেটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন-এমন কথাও বলেছিলেন সে সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের সংসদ সদস্যরা গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। তখন বিএনপি ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনা প্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘২১ আগস্টের ঘটনা বাংলাদেশের কলঙ্কতম ঘটনা। বর্তমান সরকার তো এই ঘটনার বিচার করছে। ওই সময় কী হয়েছে না হয়েছে, এখন সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’
‘কিন্তু আপনারা তো তখন ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় তদন্তের নামে এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আই হ্যাভ নো কমেন্টস। তবে এটা একটা ঘৃণিত ঘটনা। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ, এই দেশে এই ধরনের ঘটনা খুবই লজ্জাজনক।’
পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেলী ফেরদৌসী বলেন, ‘ওই সময় যেসব পুলিশ অফিসাররা এসব কাজ করেছে, এই দায় দায়িত্ব তাদের। এসব নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না, বলতে পারব না। এখন মামলা আদালতে চলছে। আসামিরা কেউ জেলে, কেউ জামিনে, কেউ পলাতক।’
আলামত নষ্ট
গ্রেনেড হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)।এই মামলার তদন্তে জোট সরকার যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একটি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। তারা দেশেও আসে। কিন্তু তখন সরকার ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া অবিস্ফোরিত গ্রেনেড নষ্ট করে দেয়। আরও নানা আলামত নষ্ট করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরেও অনুরূপ গ্রেনেড পাওয়া গেলেও সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে আমন্ত্রণ জানিয়েও কোনো রকম সহযোগিতা করা হয়নি।
পরে সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করে গোয়েন্দা সংস্থাটি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকাশ পায় যে, জোট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। তৎকালীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁর পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করতে বলেছিলেন। সে তদন্ত প্রতিবেদন আর কোনো দিন প্রকাশ করা হয়নি।
জজ মিয়া নাটক
সে সময় তদন্ত ধামাপাচা দিতে যত চেষ্টা হয়েছে, তার মধ্যে বহুল প্রচলিত হলো জজ মিয়া নাটক।
আর তদন্তের এক পর্যায়ে সব উদঘাটনের দাবি করে কথিত জজ মিয়ার জবানবন্দি নিয়ে ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফেঁদেছিলেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুর রশিদ ও সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের ভার পাওয়ার পর তিনিও হেঁটেছেন সাজানো পথে। আর সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, এক হকার জজ মিয়াই এই ঘটনার মূল হোতা।
ঘটনার ১০ মাস পার হলে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে সিআইডি আটক করে।
১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়া ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি বলেন, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড মারতে এসেছেন। কারা এই বড় ভাই? জবাবে তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালে জজ মিয়া নাটকের সব ভণ্ডুল করে দেন তার মা জোবেদা খাতুন। একটি পত্রিকাকে তিনি বলেন, জজ মিয়া গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে খোরপোষের টাকা দিয়ে আসত। জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও বলেন জোবেদা।
সাজানো বিচারিক তদন্ত
ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশন ১০ দিনের মাথায় সরকারের কাছে ১৬২ পাতার প্রতিবেদন দেয়। যেখানে ২১ আগস্টের ঘটনার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত আছে বলা হয়। কিন্তু কোনটি সেই দেশ তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বলা হয়, প্রতিবেশী একটি দেশে এই হামলার মহড়া হয়েছে। সে সময় তার এই প্রতিবেদন রীতিমতো হাসির খোরাক হয়। পরে সেটি অবশ্য আর প্রকাশ করা হয়নি।
সাজান তদন্তের ফাঁদ থেকে যেভাবে বের হয়ে আসে সরকার
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে এই মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব পান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির।
২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবির। এই অভিযোগপত্রে চারদলীয় জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু তার ভাই তাজউদ্দিন আহমেদ, হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। সেই সঙ্গে জজ মিয়াসহ ২০ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পরে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলাটির অধিকতর তদন্ত করা হয়। ওই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান জবানবন্দি দেন। যেখানে তিনি বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সেই সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং সেই সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সে সময়ের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ তৎকালীন সিআইডি ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নাম ফাঁস করে দেন।
পুনরায় তদন্তের ভিত্তিতে সিআইডি ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। দুই অভিযোগপত্র মিলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে আদালত বিস্ফোরক মামলায় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সাবেক ১১ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেন।
আসামিদের বর্তমান অবস্থান
এই মামলার অন্যতম দুই আসামি জামায়াত নেতা মুজাহিদ ও জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু কারাগারে আছেন।
অন্যদিকে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ আসামি পলাতক রয়েছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন