চীনাদের ইলেভেন ইলেভেনের কেনাকাটা

নভেম্বরের ১১ তারিখ চীনাদের একটি বিশেষ দিন। শুধুমাত্র কেনাকাটার জন্য দিনটা বিশেষ হিসেবে চীনাদের কাছে বিবেচিত হয়। সারা বছর ধরে তোড়জোড় চলতে থাকে এই দিনটার জন্য। সমস্ত বিপনি বিতানে চলে অনেক বড় বড় ডিসকাউন্ট অফার। বাদ যায়না ছোট খাট খুচরো দোকান থেকে শুরু করে মেগা শপিং মল পর্যন্ত। এমন কোন পণ্যের দোকান খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে এই দিন তাদের বেচা বিক্রিতে ছাড় দেয়না। হতে পারে সেই ছাড়ের পরিমান নিয়মিত মূল্যের থেকে শতকরা ৬০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কম। খাওয়ার রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে সবখানে চলতে থাকে এই অফার। চীনাদের অন্যান্য সব বিশেষ অনুষ্ঠানে বিপনি বিতান গুলোতে ছাড়ের ব্যবস্থা থাকলেও এই ১১ তারিখে একটু বেশিই ছাড় দিয়ে থাকে দোকান গুলো। অল্প লাভে অধিক বিক্রির আশায় এবং ব্যাবসায়িক প্রতিযোগীতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো এই ছাড়ের অফার করে থাকে।

এই দিনে সব বিপনি বিতান গুলো একটু বাড়তি ভাবে বিশেষ সাজে সাজানো হয়। বিভিন্ন আলোক সজ্জাও চোখে পড়ে এসময়ে।

নভেম্বরের ১১ তারিখ চীনাদের একটি বিশেষ দিন। দিনটাতে কেনাকাটার ক্ষেত্রে চীনারা অধিক ছাড় পেয়ে থাকে। সেজন্য এদিনটাতে সবাই ব্যতিব্যস্ত থাকে ছাড়ের আওতায় অধিক পন্য ক্রয়ের আশায়।

চীনাদের সবচেয়ে বিশ্বাস যোগ্য অনলাইন দোকান গুলো যেমন থাওবাও, ফিনদোদোউ, জেডি ডটকম, টি মলে ১০ তারিখ মধ্যরাত ০.০০ থেকে ১১ তারিখ রাত ১২.০০ পর্যন্ত চলতে থাকে এই ছাড়ের মহাযজ্ঞ। সমগ্র চীনে গত বছরের এই দিনে সংখায় প্রায় ১৯০ কোটি এর আশপাশে পন্য বিক্রি হয়েছিল অনালাইনে। আর্থিক মূল্যের দিক দিয়ে হিসেব করলে সেটার পরিমান দাঁড়ায় তিন হাজার কোটি ডলারের ও বেশি। যেটা নিঃসন্দেহে বিশ্বের যেকোন বড় বড় বিজনেস গ্রুপের লেনদেন কে হার মানায়। এই বিশাল সংখ্যা থেকেই সহজেই অনুমেয় যে এই দিনটি চীনাদের কেনাকাটার দিন হিসেবে কত বেশি জনপ্রিয়। অনলাইনের কেনাকাটায় ক্রেতাদের সাথে কথোপকথন, ক্রেতার পণ্য অর্ডার করার পরে সেগুলো প্যাকেজিং, সময়ের ভিতরে ক্রেতার নিকট সেগুলো পৌঁছে দেওয়া সহ আনুসঙ্গিক অন্যান্য কাজের সামাল দিতে সমস্ত অনলাইনের দোকান গুলোতে এই সময়টাতে নিয়োগ দেওয়া হয় হাজার হাজার কর্মী। মালামাল দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বড় বড় বিজনেস গ্রুপ প্রস্তুত রাখে জাহাজ, কারগো বিমান থেকে শুরু করে আরও আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থা।

অনলাইন কেনাকাটায় চীনারা অনেক বেশি এগিয়ে। স্বাভাবিক সময়েও তাদের দৈনন্দিন কেনাকাটার সিংহভাগই করে থাকে অনলাইন শপ হতে। সেই সাথে এবছর করোনা ভাইরাসের কারনে মানুষের চলাফেরায় কিছুটা বাধ্যবাধকতা থাকায় সকল চীনা জনগণের ভিতর অনলাইন কেনাকাটায় আরও বেশি তৎপরতা দেখা গেছে। তাই বিশেষজ্ঞ দের ধারণা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবছরের ১১ তারিখের বিক্রি রেকর্ড হতে পারে।

নভেম্বরের এগারো তারিখটি চীনাদের কাছে eleven eleven বা double eleven নামে পরিচিত। এই তারিখে চারটি সিঙ্গেল সংখ্যা অর্থাৎ চারটি ১ ব্যবহৃত হওয়ায় অবিবাহিত প্রেমিক যুগলদের জন্য অর্থাৎ যারা এখনো একা (single) আছে তাদের উদ্দেশ্যে চীনা অনলাইন শপ ‘আলিবাবা’ এই দিনটিতে অনলাইন শপিং এর ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের প্রচলন শুরু করে। পরবর্তীতে আলিবাবার সাথে তাল মিলিয়ে জেডি ডট কম সহ অন্যান্য দোকান গুলো ছাড়ের প্রচলন করলেও প্রতিষ্ঠান আলিবাবা এই বেচা বিক্রিতে এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে। দিনটি মূলত অবিবাহিত প্রেমিক যুগলদের উদ্দেশ্যে ‘আলিবাবা প্রতিষ্ঠান’ চালু করলেও এখন আর সেটি অবিবাহিত বা প্রেমিক যুগলদের ভিতর সীমাবদ্ধ নেই। এই দিনটার ছাড়ের আওতায় যেহেতু ক্রেতাদের বয়সের বা অন্য কোন রকমের বাধ্যবাধকতা নেই তাই যেকেউ হর হামেসাই মধ্যরাত থেকে অফার চলাকালীন সময়ে অনালাইনে পন্য কিনতে ব্যস্ত থাকে।

অফার শেষ হওয়ার দুই দিন পর হতেই ক্রয়কৃত পন্য হাতে পেতে শুরু করে ক্রেতারা। আর তখন থেকে পন্য ডেলিভারি দেওয়া নিয়ে দোকান গুলোতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সরাসরি হাতেহাতে ডেলিভারির পাশাপাশি প্রতিটি জনবহুল এলাকায় এসব অনলাইনে ক্রয়কৃত পণ্যের ডেলিভারি দেওয়ার একের অধিক দোকান অবস্থিত আছে। অন্য সময় মানুষের স্বাভাবিক আনাগোনা থাকলেও এই অফারের পরের ১৫ দিন পর্যন্ত অস্বাভাবিক ভিড় লক্ষ্য করা যায়। দোকান গুলোর কর্মকর্তারা ও ভিড়কে সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যায়। কাঙ্ক্ষিত পন্য হাতে পাওয়ার আশায় ক্রেতাদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু সময় ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তারপরেও ক্রেতাদের চোখেমুখে থাকে অধিক আনন্দের ছাপ। কেননা একটু পরেই তারা তাদের সেই অর্ডারকৃত পন্য হাতে পেতে যাচ্ছে।

চীনের এই ইলেভেন ইলেভেনের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন অনালাইন শপিং দোকান যেমনঃ আলিবাবার বভিন্ন ব্যবসায়িক অঙ্গসংগঠন, দারাজ অনালাইন শপিং সহ আরও নানান শপ গুলোতে ছাড়ের ব্যবস্থা চালু করেছে। তাদের মাঝেও চলছে অল্প লাভে বিশেষ ছাড়ের মাধ্যমে একদিনে অধিক পণ্যের বেচা বিক্রির ধুম।

আমরা যারা প্রবাসী তারাও চীনাদের সাথে তাল মিলিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি এই বিশেষ দিনটার জন্য। চেষ্টা করি যথাসম্ভব আগামী দিনগুলোর জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সহ শখের জিনিস বিশেষ ছাড়ে কিনে রাখতে।

লেখকঃ
অজয় কান্তি মন্ডল
পিএইচডি ফেলো,
ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি
ফুজিয়ান, চীন।চীনাদের ইলেভেন ইলেভেনের কেনাকাটা