‘ছেলে জানে না আমি তার মা’!
সম্প্রতি ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ছয় সন্তানের মা দালাল আবু আল-হাওয়া।
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বজনদের কাছে ফিরে অন্য মানুষ যেখানে খুশিতে আপ্লুত হন, সেখানে করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
এই মা গর্ভধারিনী মাকে চিনতেই পারছে না তার ২২ মাস বয়সী ছেলে হামজা। তার বয়স যখন ১০ মাস, তখন তার মাকে মিথ্যা অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় ইসরাইলি আদালত।
সেই কারাদণ্ড ভোগ করে গত ৭ আগস্ট ছাড়া পেয়েছেন আল-হাওয়া। মুক্তির পর থেকে তার ঘুমে সমস্যা হচ্ছে এবং তিনি পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না। ফলে তাকে একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে হচ্ছে।
পরিস্থিতির ব্যাপারে তিনি বলছিলেন, আমার ছোট ছেলে আমার কাছে আসতে চায় না। আমি তাকে কোলে নিতে চাই। কিন্তু সে আমার হাতে আঘাত করে দূরে সরে যায়।
ইসরাইলি বন্দিশালায় আটক হামাস সদস্যদের টাকা দেয়ার চেষ্টা করছেন, এমন অভিযোগে আল-হাওয়াকে গত বছরের ২৮ আগস্ট জেলে পাঠানো হয়।
গত এক বছর ধরে কারাগারে থাকার সময় তার সঙ্গে স্বামী ও সন্তানকে দেখার করার অনুমতি পর্যন্ত দেয়নি ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
একই সময় আল-হাওয়ার বড় ছেলে ওমরকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেয় ইসরাইলি আদালত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দখলদার ইসরাইলি সেনাদের দিকে ককটেল ছুঁড়ে মারে সে।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ পশ্চিম তীরের উত্তরে মেগিদ্দো কারাগারে এখনও বন্দি জীবন কাটাচ্ছে ওমর।
আল-হাওয়া গত অক্টোবরের একটি দিনের কষ্টের কথা আজও স্মরণ করেন। ওইদিন মা-ছেলে, দুজনকেই আদালতে হাজির করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমি বাস থেকে নামছিলাম, অন্যদিকে পেছনের দিকে একটি সামরিক জিপে বসা ছিল ওমর।
আল-হাওয়া বলেন, ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে আমার খুব ইচ্ছা করছিল। এক পর্যায়ে আমি তাকে জড়িয়েও ধরলাম। তখন পুলিশ টেনে হেঁচড়ে তার কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে নেয় এবং তার পেটে লাথি দিতে থাকে। মা হিসেবে কোনো মায়ের পক্ষে এমন দৃশ্য দেখা কঠিন। এরপর তারা আমার ছেলেকে হুমকি দিয়ে বলে আমরা যদি দূর থেকেও কথা বলি তাহলে তাকে পিটুনি দেবে।
অন্য কারাবন্দিদের মতো আল-হাওয়াকেও পূর্ব জেরুজালেমের বন্দিশালায় দীর্ঘ ২৩ দিনব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদকালে অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয় বলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারতাম না যে কখন রাত, আর কখন দিন। তারা (ইসরাইলি পুলিশ) কখনোই বাতি নিভাতো না, এমনকি রাতের বেলাতেও না। তারা খুবই কম তাপমাত্রায় এসি ছেড়ে রাখত, যার ফলে আমি ঠাণ্ডায় জমে যেতাম।
ফিলিস্তিনি মা বলেন, আমি যে কক্ষটিতে বন্দি ছিলাম, সেখানে কোমল পানিয়ের একটি বোতল খুঁজে পেয়ে তাকে ঘুমানোর বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতাম। আমি যখন ক্লান্তিতে ঘুমে ঢলে পড়তাম তখন দরজায় বিকট শব্দে ঘণ্টা বেজে ওঠত। সেখানে আমার ওপর নজরদারি করার জন্য তিনটি ক্যামেরা ছিল। কারারক্ষীরা আমাকে একটি কম্বল দিয়েছিল যা থেকে উৎকট গন্ধ বের হতো। আর আমি যখন বাথরুমে যেতাম তখনও আমাকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো।
আল-হাওয়া বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে মানসিক নির্যাতন করা হয়। সেখান তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জেরা করা হতো।
জিজ্ঞাসাবাদকালীন বিভীষিকার করতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি। ওই সময় একাধিক ইসরাইলি কর্মকর্তা উপর্যুপরি প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করত এবং চাপ দিত বলে জানান তিনি।
আল-হাওয়া জিজ্ঞাসাবাদের একটি নিষ্ঠুর নয়া পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন।তিনি বর্ণনা করেন, জেরাকারীরা তাকে একটি দেয়াল ঘেষে এমনভাবে বসাতো যাতে তাকে মনে হতো যেন ঝুঁকে বমি করছেন তিনি। সেখানে তারা বন্দিকে এসির অত্যন্ত ঠাণ্ডা তাপমাত্রার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখত।
তবে আল-হাওয়ার অগ্নিপরীক্ষা কারাগারেই শেষ হয়ে যায়নি। তিনি মুক্তি পাওয়ার পর জেরুজালেমে পরিবারের কাছে তার ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইসরাইল। এর মানে হলো, তাকে অবশ্যই অবরুদ্ধ পশ্চিম তীর এলাকায় থাকতে হবে।
জেরুজালেম আর পশ্চিম তীর ইসরাইলের অবৈধ দেয়াল দিয়ে বিভক্ত, ফলে তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, আমি যখন আদালত ত্যাগ করছিলাম, তখন তারা আমার স্বামীকে আদেশটি ধরিয়ে দিয়ে বলে যে আমাকে আমাকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। অথচ আমার স্বামী গত জুলাই মাসে একটি বাড়ি ভাড়া করে তা আমার থাকার জন্য সাজিয়েছিলেন। আর যখন আমি কারাগার থেকে মুক্তি পেলাম, তখন এখানে চলে আসলাম।
এখন তার পরিবারের সদস্যদের ইসরাইলি সামরিক তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে স্কুলে যোগ দিতে বা হাসপাতালে ও পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতে হয়ে।
আল-হাওয়ার পরিবারের সব সদস্যের রয়েছে জেরুজালেমের পরিচয়পত্র। অন্যদিকে শুধু তাকেই পশ্চিম তীরের পরিচয়পত্র বহন করতে হচ্ছে। দখলদার ইসরাইল তাকে জেরুজালেমে বসবাস করতে না দেয়ায় তাকে আলাদা পরিচয়পত্র নিতে হয়েছে।
এ অবস্থায় তিনি পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়ে ফের জেরুজালেমে বসবাসের জন্য ইসরাইলের কাছ থেকে একটি অনুমতিপত্র যোগার করতে সক্ষম হয়েছেন, যা এক বছর পর পর নবায়ন করার বিধান রয়েছে; কিন্তু এরইমধ্যে এ অনুমতি বারবার নাকচ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
দখলদার বাহিনীর এমন নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারে আদামির বন্দি অধিকার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী সাহার ফ্রান্সিস বলেন, নিরাপত্তার অযুহাতে জেরুজালেমে বসবাসের বৈধ অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও যে কাউকে সেখানে নিষিদ্ধ করতে পারে ইসরাইল। এমনকি তারা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াই বাতিল করে দিতে পারে।
ইসরাইলের এ ধরনের বর্বরোচিত নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধাপরাধের শামিল বলে নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, রোম সংবিধি অনুযায়ী গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিধান মতে, কোন অবরুদ্ধ জনপদের জনগণের যেকোনো অংশকে বহিষ্কার করা এবং জোর করে স্থানান্তর করা যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।
এছাড়া যে কারো নিজ দেশে ফিরতে পারার অধিকার মানবাধিকার আইন দিয়ে সুরক্ষিত।
কিন্তু আল-হাওয়াকে জেরুজালেমের পার্শ্ববর্তী আল তুর এলাকার নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কী কী মুসিবত অপেক্ষা করছে তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, আমার ছয় সন্তানের জেরুজালেমের আইডি আছে এবং তারা সেখানকার স্কুলে যায়। ফলে আমি জানি না যে পশ্চিম তীরে বসবাস করে কিভাবে তা সামলাবো। যদি আমার সন্তানেরা অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে কিভাবে তাদের আমি জেরুজালেমে নিয়ে যাব? শুধু তাদের বাবাই নিয়ে যেতে পারবে।
আল-হাওয়া বলেন, স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা। যেখানে আমি বসবাস করি, তার এবং আমার নিজ শহর আল তুরের মধ্যে দেয়াল রয়েছে। ফলে আমি জানি না কীভাবে এ বাস্তবতা সামলাবো। আমি জানি না কিভাবে আমার ছোট ছোট সন্তানেরা প্রতিদিন তল্লাশি চৌকি পার হয়।
পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের মধ্যে যেসব তল্লাশি চৌকি রয়েছে তাতে খুব কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেইজ্জতির সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর এক এপর ওপার যেতে ২০ মিনিটের বাস যাত্রা করতে হয়।
আল-হাওয়ার স্বামী আবু ওমর বলেন, তার স্ত্রী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েও জেরুজালেমের বাড়িতে ফিরতে না পারায় তার খুশি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
আফসোস করে তিনি বলেন, আমাদেরকে এখন ওয়েস্ট ব্যাংকে বাড়ি ভাড়া করতে হবে আর বড়টা ছেলেটা তো এখনও জেলখানাতেই আছে। সব প্রশংসার আল্লাহর, কখনোই সুখ পরিপূর্ণ হয় না।
আবু ওমর বলেন, বউ ছাড়া জীবন যাপন করা ‘খুবই কঠিন’। আপনি যতক্ষণ এমন অভিজ্ঞতার শিকার না হবেন, ততক্ষণ এটি বুঝবেন না। আমাকে একা একা পাঁচটি বাচ্চার দেখাশোনা করতে হয়।
তিনি বলেন, আমি জানতাম না যে কীভাবে আমার ছোট্ট ছেলেটার ডায়াপার বদলাতে হবে ও তাকে দুধ খাওয়াতে হবে। আর আমার মেয়েটিও এখনো খুবই ছোট। যখন আমার কোনো একটি বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাদেরকে ডাক্তারের কাছে ছুটে যেতে হয়। এসব ব্যাপার আমার জন্য খুবই কঠিন। আমাদের যে ছেলেটার বয়স চার বছর, সে সারা দিন তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে এবং বলে, কখন মা বাড়ি ফিরবে? তার কথা শুনে কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়।
আবু ওমর বলেন, আমাদের সবচেয়ে ছোট ছেলে হামজা তার তার মায়ের কাছে যায় না। আমার স্ত্রী যখন জেলে ছিল, আমি বাসায় তার দুটি বড় ছবি ঝুলিয়ে রাখি এবং তাকে বলি এটি ‘মা’, ফলে সে মায়ের কথা ভুলে যায়নি। কিন্তু যখন তার মা জেল থেকে মুক্তি পেল তখন হামজা মোটেই তার কাছে যায়নি।
মায়ের মুক্তি পেয়েছে এক সপ্তাহ হলো। কিন্তু এখনো হামজার ধারণা হয়নি যে এই হলো তার মা।
আল-হাওয়া বলেন, সে আমার কথা মনে করতে পারে না। যদি আমি তাকে চুমু দিতে চাই বা জড়িয়ে ধরতে চাই তাহলে আমাকে অপেক্ষা করতে হয় যে সে কখন সে ঘুমিয়ে পড়বে।-আল জাজিরা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন