জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি

কৃষি সমৃদ্ধ বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রধান সংকট পানি। ওই অঞ্চলে পানি স্তর এতটাই অনুন্নত যে অগভীর বা গভীর কোনো নলকূপেই পানি পাওয়া যায় না। এ কারণে সেচ কাজের জন্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু প্রকল্পের সুফল পাওয়া গেলেও অধিকাংশ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে ধীরগতিতে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বৃহত্তর রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় অনেক কম। আবার বৃষ্টিপাত যথাসময়ে হচ্ছে না। এ ছাড়া সংস্কারের অভাবে নদী, খাল ও বিলগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ায় কৃষিকাজ ক্রমান্বয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ও কৃষকদের সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ‘বরেন্দ্র এলাকায় খালে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে বরেন্দ্র এলাকার খালে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ করে সেচ সুবিধার বর্ধিত করে তিন হাজার ৭৮০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এনে বছরে ৩৭ হাজার ৮০০ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য উৎপাদন। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য উন্নয়নে ৮০ হাজার ফলদ, বনজ ও ‌ওষধি বৃক্ষ রোপণ এবং প্রকল্প এলাকায় শ্রমিক ও প্রান্তিক চাষিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন।

সরেজমিনে জানা গেছে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়িত ১১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি আগামী জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও প্রায় এক-চতুর্থভাগ কাজ বাকি রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৩৮ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত ৩২ দশমকি ৫০ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে।

১৬টি ক্রসড্যামের মধ্যে ১১টি নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পনটুন নির্মাণ ও ডায়া পাইপ লাইন নির্মাণে কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি। ফলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের সুবিধা পাবেন না কৃষকরা। তবে এই প্রকল্পের পাশাপাশি প্রকল্পগুলো যথাযথ ভাবে বাস্তবায়িত হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের আশা ব্যক্ত করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে সেচ কাজে ভূ-পরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৩২টি পুকুর ও এক হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হয়েছে।

বরেন্দ্র এলাকার ভূমি উঁচু-নিচু হওয়ায় পানি সংরক্ষণের জন্য খালে ৬৯৬টি ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, ইতিমধ্যে নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার হার্ড বরেন্দ্র এলাকা ছাওড় ইউনিয়নে বছরব্যাপী সেচ কার্যক্রমের জন্য ১৭ একরের একটি জলাধার পুনঃখনন করা হয়েছে। সেচ কাজে নদীর পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে গোদাড়ীতে পদ্মানদী থেকে দুটি স্থাপনা হতে ৪৮ কিউসেক পানি উত্তোলন করে ৩ দশমকি ৫ কিলোমিটার দূরে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সরমংলা খালে স্থানান্তর করা হচ্ছে।

খাল থেকে বিভিন্ন স্থানে পাম্পের মাধ্যমে দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বছরব্যাপী সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা, মহানন্দা ও আত্রাই নদী থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে সরাসরি জমিতে সেচ প্রদানের কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তবে ট্রাস্ট ফান্ডের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংসদীয় কমিটির পাশাপাশি এ বিষয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো।

এ বিষয়ে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ (এনসিসিবি) ট্রাস্টের কো-অডিনেটর মিজানুর রহমান বিজয় বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পগুলো নেওয়া হলেও সেখানে স্থানীয় জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যার তদারকি ব্যবস্থাও খুব দুর্বল। এ কারণে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলছে। এমনকি প্রকল্প বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টকে শক্তিশালী করতে মনিটারিং ব্যবস্থা জোরদারের আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে, সংসদীয় কমিটির প্রশ্নের জবাবে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সরকার রাজস্ব বাজেট থেকে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৭২টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪০৯টি সরকারি ও ৬৩টি বেসরকারি প্রকল্প রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি ১৩৪টি ও বেসরকারি ৫৭টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। বিভিন্ন কারণে বেসরকারি ছয়টি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।