জাতীয় নাগরিক পার্টি: রাজনৈতিক দল হওয়ার প্রেক্ষাপট

জাতীয় নাগরিক পার্টি: রাজনৈতিক দল হওয়ার প্রেক্ষাপট
মো. আশরাফুজ্জামান
১.
২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন বাংলাদেশের তরুণ শক্তিকে একত্রিত করেছিল, ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃতাধীন সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। একই সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনকে বিরোধীদলসমূহ নিশি রাতের নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেন। তবে, এই নির্বাচন দেশের তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেশ নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, বিশেষত যে সকল তরুণ ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে থাকেন।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন, তরুণদের পথ উন্মুক্ত করেছিল। ডাকসু ভি.পি. নির্বাচিত হয়েছিলেন নুরুল হক নূর। নূরুল হক নূর পরিবর্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করেন যা গণঅধিকার পরিষদ নামে পরিচিত। নুরুল হক নূরের সাথে কোটা আন্দোলন ও ডাকসুর অন্যতম সহযোগী ছিলেন ডাকসু সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। নুর-আখতার এর ডাকসুর দায়িত্বের অবসান হলে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর আখতার নূরকে ছেড়ে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। সেই সংগঠনের আহবায়ক ছিলেন আখতার হোসেন, সদস্য সচিব নাহিদ ইসলাম, সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহবায়ক ছিলেন জনাব আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া ও সদস্য সচিব আবু বাকের মজুমদার।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির মূল মন্ত্র ছিল-শিক্ষা, শক্তি ও মুক্তি। দায়, দরদ ও মানবিক মর্যাদা ভিত্তিক রাজনৈতিক সমাজ গঠন করাই এটির আদর্শ ছিল। এই সংগঠনের রাজনৈতিক অবস্থান মধ্যমপন্থী ও গণতান্ত্রিক। সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল — শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তি, পরিসর ও সংস্কৃতি নির্মাণ, শিক্ষার্থী কল্যাণ, ছাত্র-নাগরিক রাজনীতি নির্মাণ ও রাষ্ট্র-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন।
২.
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় রাজনীতিতে একটা ভ্যাকিউম তৈরি হয়, বিরোধী রাজনৈতিক জোট নির্বাচনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত আন্দোলনে সফল না হলে তাদের আন্দোলনে ভাটা পড়ে, বড় শরিক জামায়াত ও বিএনপির জোট ভেঙে যায়, ২০২২ সালে সেটি সামনে আসে এবং উভয়ই দল যুগপৎভাবে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়।
তৎকালীন আওয়ামী সরকারের কাছ থেকে দেশকে পুনরূদ্ধার করতে বিএনপি ৩১ দফা ঘোষণা করে। ২০২৩ সালের ১২ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করে, যুগপৎভাবে জামায়াত দশ দফা সহ ছোট রাজনৈতিক দল ও মোর্চাসমূহ আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন সরকার বিরোধীদলসমূহের সেই আন্দোলনে ক্রমশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বিরোধী দলসমূহের ধারণা ছিল ২০২৩ সালের আন্দোলনে তারা সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে সক্ষম হবেন, কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে সরকার ২৮ অক্টোবর ২০২৩ বিএনপির আন্দোলনে ক্রাকডাউন করে ভণ্ডুল করে দেয় ।
এরপর থেকেই বিরোধীদলীয় আন্দোলনে ভাটা পড়ে, এবং সরকার দলীয় আওয়ামীলীগ একতরফাভাবে ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে জয়ী হয়। আওয়ামীলীগ নতুন উদ্যমে সরকার গঠন করে, বিরোধীদলসমূহ সেই নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে অভিহিত করেন। মজার বিষয় হল দীর্ঘদিন বিরোধীদলীয় প্লাটফর্মে আন্দোলন করলেও সেই নির্বাচনে বিএনপির শাহজাহান ওমর ও কল্যান পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ ইব্রাহিম সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের ক্ষোভে পতিত হন। যাই হোক, নতুন আত্মবিশ্বাসের সাথে দেশের হাল ধরে তৎকালীন আওয়ামীলীগ, অন্যদিকে বিরোধী দলীসমূহের মধ্যে আন্দোলনে কিছুটা স্তিমিতভাব চলে আসে।
৩.
আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ৫ জুন ২০২৪ সাল, সরকার কর্তৃক ইতঃপূর্বে ২০১৮ সালে জারিকৃত কোটা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট। এই রায়টি আসে মূলত ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিটটি দায়ের করেছিলেন।
এই আদেশের পর থেকে ছাত্র সমাজের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছে মাত্র পাঁচ মাস আগে, সে সময়ে এমন রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কোটা আগের অবস্থায় ফেরত আনা যথেষ্ট কষ্ট সাধ্য ছিল। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের বেশ কিছু রাজনৈতিক সচেতন তরুণ এগিয়ে আসেন। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব নাহিদ ইসলামকে সমন্বয়ক করে যাত্রা হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এই ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ক্রমশঃ কোটা বিলোপের পরিপত্র বহাল করে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন জোরদার করেন।
বিগত সময়ে বিরোধীদলসমূহের উপর ক্রাকডাউন, নির্বাচনে আওয়ামীলীগের এক তরফা জয়ের পর তাদের নতুন উদ্যমের প্রভাব ও সরকারের যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের কারণে আন্দোলনের সমন্বয়কগণ রাজনৈতিকভাবে পরিচিত মুখ এড়িয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে সংযুক্ত রেখে আন্দোলন চালিয়ে যান। তারা ব্লকেড, বাংলা ব্লকেড সহ বহুমুখী শিক্ষার্থী বান্ধব কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। এই আন্দোলনে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির জনবলকে সামনে রেখে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, ছাত্রঅধিকার পরিষদ, বিভিন্ন বামপন্থী দলসহি দল নিরপেক্ষ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতে থাকা অবস্থায়, তারা কোটা আন্দোলনে ‘এক দফা’ ঘোষণা করেন, তাদের দাবী ছিল, ‘সকল গ্রেডে আযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাশ করতে হবে।’
আন্দোলন চলা অবস্থায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর আপিল বিভাগ ১০ জুলাই ২০২৪ সরকারি চাকরিতে কোটা বহালে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা প্রদান করেন এবং শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসে ফেরার পরামর্শ প্রদান করেন। শিক্ষার্থীরা সুপ্রিমকোর্ট এর আদেশের প্রতি সম্মান জানায় সেই সাথে ঘোষণা করে তাদের আন্দোলন চলমান থাকবে এবং কোটা সংস্কারে সরকারের দায়িত্বের উপরই তারা জোর দিতে থাকেন।
৪.
তিনদিনের মধ্যে পালটে যায় চিত্র। চীন সফরে থাকা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ দেশে ফেরেন। ১৪ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?”-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যের জের ধরে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ শুরু করলে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়। ছাত্রলীগের হামলা কোটা আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত।
শিক্ষার্থীদের উপর এই হামলার প্রতিবাদ মুহুর্তে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা পালটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে দেশব্যাপী। সেদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে সারাদেশে বেশ কয়েকজন নিহত হন, রংপুরে নিহত হন আবু সাঈদ, নিরস্ত্র হস্ত প্রসারিত থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ছবি মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় তীব্র প্রতিবাদ। শিক্ষার্থীরা সর্বাত্মক ‘শাট ডাউন’ কর্মসূচির ডাক দেয়।
শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবী করেন। সরকার ও আওয়ামীলীগ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে ক্রমেই কঠোর হতে থাকে, বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। সরকার ১৬ জুলাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। তবে, পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার- ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেয় এবং ১৯ জুলাই থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে।
একই দিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীরা ‘নয় দফা’ দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ২৫ জুলাই থেকে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবী করে কারফিউ শিথিল করতে থাকে।
৫.
২৬ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়, পরে সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। ২৮ জুলাই হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের স্বাক্ষরিত একটি পত্র ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে তাদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পড়ে শোনাতে দেখা যায়। তাদেরকে জোর করে এই চিঠি পড়ানো হয়েছে দাবী করে দ্বিতীয় সারির সমন্বয়কগণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে থাকেন, আব্দুল কাদের, আব্দুল হান্নান মাসুদ, রিফাত রশিদসহ অনেকে। আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে, ভিডিও ও চিঠিকে জোরপূর্বক আদায়করা হয়েছে বলে দাবী করেন। পরবর্তীতে আন্দোলনে কিছুটা জন সম্পৃক্ত কর্মসূচি প্রদান করা হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘লাল রঙের প্রতিবাদ’ ‘গ্রাফিতি অঙ্কণ’ ও ‘মার্চ ফর জাস্টিস’সহ নানা কর্মসূচি।
৬.
১ আগস্ট সরকার আন্দোলনে জামায়াত শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঐদিনই সরকার সমন্বয়কগণকে মুক্তি প্রদান করে, মুক্তি লাভের পর ২ আগস্ট সমন্বয়কগণ দাবী করেন তাদেরকে ডিবি কার্যালয় থেকে জোর পূর্বক কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা প্রদান করানো হয়েছে। তাদের মুক্তিতে আন্দোলন প্রাণ ফিরে পায়, ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে এবং নয় দফা আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৩ আগস্ট শহিদ মিনারে ‘ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশ থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে পূর্ববর্তী ৯ দফার পরিবর্তে ১ দফা ঘোষণা করা হয়।
সমন্বয়ক নাইদ ইসলাম সেই ঘোষণায় বলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা দাবির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এক দফাটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ।’(প্রথম আলো অনলাইন, ৩ আগস্ট ২০২৪)। উল্লেখ্য সেদিন লক্ষ মানুষের স্রোত নামে ঢাকা শহরে, সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অভিভাবক মহল নেমে আসেন রাস্তায়। ছাত্র শিক্ষক, শিক্ষার্থী-অভিভাবক, শ্রমিক-পেশাজীবী, নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ, বুদ্ধিজীবী-অভিনেতা-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-খেলোয়াড়সহ সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ সংঘটিত হত্যার বিচারের দাবীতে একীভূত হয় শহিদ মিনারে। উপর্যুক্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা ১ দফার সাথে সহমত পোষণ করেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে নাহিদ বলেন, “আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে আর কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে৷” তিনি ৪ আগস্ট থেকে ‘এক দফা দাবী’ বাস্তবায়নে ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দেন। ৪-৫ আগস্ট বিক্ষোভ সমাবেশ, স্মৃতিফলক উন্মোচন সহ নানা কর্মসূচি এবং ৬ আগস্ট ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষিত হয়।পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের বাস্তবায়নে ছাত্র-জনতাকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
৭.
অসহযোগ আন্দোলন বাস্তবায়নে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে সরকার ৪ তারিখ সন্ধ্যা হতে দ্বিতীয়বারের মত সর্বাত্মক কারফিউ ঘোষণা করে অন্যদিকে এর প্রেক্ষিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি ও হত্যার প্রতিবাদে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পূর্বে এই কর্মসূচি মঙ্গলবার পালনের কথা বললেও এখন সেটি পরিবর্তন করে একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। ফলে আগামীকাল ৫ আগস্ট তারা লং মার্চ চু ঢাকা কর্মসূচি পালন করবেন।
৪ মার্চ নির্ঘুম রাত পার করে বাঙালি, সকালে কী হতে চলেছে? সকাল ১০ টা পর্যন্তও পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়, কিন্তু দ্রুতই রাজপথ জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, দুপুরে জানা যায় সেনাবাহিনী প্রধান জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। জনতার বুঝতে বাকী থাকে না, তাদের বিজয় অর্জিত হতে চলেছে।
মুহুর্তেই কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, শাহবাগকে কেন্দ্র করে পুরো ঢাকা শহর মানুষে ছেয়ে যায়, গণভবনে ঢুকে পড়ে জনতা, সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সব কিছুই জনতার পদভারে প্রকম্পিত। জনতা উল্লাসে বিজয় উদযাপন করে, ১৬ বছরের বেশি দম বন্ধ হওয়া পরিস্থিতি থেকে তারা মুক্তি পায়। গণভবনের মাঠে জনতাকে সিজদায়ে শুকুর দিতে দেখা যায়, অনেকে আনন্দের কান্নায় কোলাকুলি করে। নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠা গণভবনের সব কিছু জনগণ নিজের মনে করে নিয়ে যায়, হাঁস, মুরগি, ছাগল, খরগোশ মাছ, অবশ্য পরে সেনাবাহিনীর আহবানে জনগণ অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেয়।
৮.
ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রস্ফুটিত। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দলোনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবীতে শুরু হওয়া আন্দোলন এক দফায় রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়।
প্রাথমিকভাবে এটি কোটা সংস্কার আন্দোলন হলেও পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিকরূপ লাভ করে। ছাত্র-জনতা হত্যার দায়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কগণ আওয়ামীলীগ সরকারকে দায়ী করেন ১ দফা দাবী পেশ করে, রাজনৈতিক দলগুলো সেটিতে সম্মতি প্রদান করে, সকলের সম্মিলিত দাবী বাংলাদেশের পরিচালনায় গেড়ে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পতন। যেটি ৫ আগস্ট বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে তরান্বিত হয়।
৯.
৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নতুন সরকার গঠন করতে তিনিদিন সময় লেগে যায়, ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই সরকারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। একজন নাহিদ ইসলাম এবং অন্য জন্য আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। ছাত্রদের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগদান করেন মাহফুজ আলম।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের একমাস পর ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ‘জুলাই গণহত্যার বিচার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে’ জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়, যা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে সেটি পূরণের জন্য গঠন করা হয়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক হন নাসিরুদ্দীন পাটোওয়ারি ও সদস্য সচিব হন আখতার হোসেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যৌথ প্রচেষ্টায় তারা জুলাই অভ্যুত্থান কে উপজীব্য করে নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজ করতে থাকে। এমনকি তারা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ জারীর উদ্যোগ নেয় কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন, ফলে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দল গঠনে মনোনীবেশ করেন।
১০.
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে জুলাই অভ্যত্থানের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে যাত্রা করে ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’, দুই দিন পর ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের মানিক মিয়া এভিনিউ এর রাস্তায় লক্ষ ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে ঘোষণা করা হয় নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র। জাতীয় নাগরিক পার্টির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নাহিদ ইসলাম, যিনি ইতঃপূর্বে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নতুন এই রাজনৈতিক দল দেশের মানুষের সামনে এমন এক সময় যাত্রা করল, যখন দেশের মানুষের সামনে দেশ গড়ার অপার সুযোগ এসেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দেশ ও জনগণের পক্ষে থেকে একটি উদার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে এই তরুণদের যাত্রা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দল গঠন ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বন্ধুর পথ অতিক্রম করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নির্যাস ধারণ করে গিয়ে যাবে এই দল, সেই কামনা।
মো. আশরাফুজ্জামান
প্রভাষক,
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন