জাল সনদে ১৫ বছর ধরে অধ্যক্ষ! চাকরি দিয়েছেন স্ত্রী, দুই ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীকে
শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জাল। তদন্তে এটা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু তারপরও ১৫ বছর ধরে চাকরিতে বহাল অধ্যক্ষ। এই অধ্যক্ষের নাম এসএম আবুল কালাম আজাদ।
তিনি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার সরদার কাজিমুদ্দিন টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ।
জাল সনদে চাকরি নেওয়া অধ্যক্ষ স্বাক্ষর জালিয়াতি করে নিজের স্ত্রীসহ পরিবারের চারজনকে চাকরি দিয়েছেন। তদন্তে এটাও প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু তারাও চাকরিতে বহাল। কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দীর্ঘদিন পর গত ২২ জুলাই নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের এমপি আবদুল কুদ্দুস একটি চিঠি দিয়ে বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের সচিবের নজরে এনেছেন।
এখন আবার নতুন করে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালককে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (ভোকেশনাল) কবির আল আসাদ এক চিঠিতে তাকে তদন্তের এই দায়িত্ব দেন। চিঠিতে এমপি আবদুল কুদ্দুসের তিনটি অভিযোগের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান অভিযোগ অধ্যক্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএসএস সনদ জাল। দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধির স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। আর তৃতীয় অভিযোগ হলো- সহকারী লাইব্রেরিয়ান সাইফুল ইসলামের লাইব্রেরিয়ান সনদ, কম্পিউটার ল্যাব সহকারীর সুফিয়া খাতুনের ল্যাব সনদ ও বাংলার প্রভাষক মোসাম্মৎ নুরুন্নাহারের মাস্টার্স সনদ জাল এবং কম্পিউটার অপরাশেনের প্রভাষক এসএম সফিকুল ইসলামেরও সনদে সমস্যা আছে। এদের মধ্যে নুরুন্নাহার অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী। সুফিয়া খাতুন অধ্যক্ষের বড় ভাইয়ের স্ত্রী। আর সাইফুল ও সফিকুল অধ্যক্ষের ভাই। তাদের নিয়োগ হয়েছে জালিয়াতি করে।
২০০৫ সালেই তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম রাব্বানী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে সনদ ও স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি অবহিত করেন।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, সনদ জালের অভিযোগ পাওয়ার পর অধ্যক্ষকে সনদ দাখিল করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি দাখিল করেননি। তাই সাময়িক বরখাস্ত করে তার বেতন বন্ধ করা হয়। তারপরও অধ্যক্ষ যোগাযোগ করেননি। তারা তদন্ত করে জানতে পারেন অধ্যক্ষের সনদ জাল। তাই তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু অধ্যক্ষ উচ্চ আদালতে একটি রিট করে চার মাসের জন্য বরখাস্তের আদেশের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। তারপর থেকে অধ্যক্ষ নানা কৌশলে আদালতে বিচার দীর্ঘ করাচ্ছেন।
সরদার কাজিমুদ্দিন টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, অধ্যক্ষ নিজের নিয়োগ থেকে সবকিছুই করেছেন জালিয়াতি করে। এর আগেও একাধিকবার তদন্তে এসব ধরা পড়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। প্রতিবারই মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে পার পেয়ে গেছেন। জাল সনদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি এলাকার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা সবাই জানে। আর এ কারণে অনেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হতে চায় না। এবার নতুন করে তদন্ত শুরু হলেও উচ্চ আদালতে পিটিশন থাকায় অধ্যক্ষ এর বাইরে থাকছেন। এখন অধ্যক্ষের পরিবারের চার সদস্যের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এভাবেই অধ্যক্ষ পার পেয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে ২০০৭ সালেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা বিভাগের অডিট অফিসার মোকলেছুর রহমান এবং সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক এসএম মুনজুরুল হক সরদার কাজিমুদ্দিন টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে সরেজমিন তদন্ত করেন।
তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টই বলা হয়, অধ্যক্ষের সনদ জাল। তদন্তকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের সনদ জাল বলে চিঠির মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে নতুনভাবে নুরুন্নাহার, মিজানুর রহমান ও আবদুর রহিমকে এমপিওভুক্ত করা হয়। কিন্তু শুধু রহিমের এমপিওভুক্ত করার কাগজপত্র পাঠানো হয়। এতে প্রমাণিত হয়, অন্য দুজনের নিয়োগ ও এমপিও হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। ওই সময় প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির ছয়জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন অধ্যক্ষের পরিবারের সদস্য। অধ্যক্ষ, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার ও শিক্ষক মিজানুরের নিয়োগ হয়েছে ২০০৩ সালে। একই বছর অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীও নিয়োগ হয়। এতে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার বোর্ডে নাটোরের সিংড়া উপজেলা সদরের গোল-ই আফরোজ সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল ও আবদুল জলিলকে মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ওই সময় গোল-ই আফরোজ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পদেই ছিলেন না। তাদের নাম ব্যবহার করে স্বাক্ষর জাল করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে জাল স্বাক্ষরে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৎকালীন চিফ ইন্সট্রাক্টর শাহ সলিমুল্লাহ আহমেদকেও মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ এসএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আগের তদন্ত প্রতিবেদনে আমার সনদ জাল বলা হয়েছে সঠিক। কিন্তু আমি তার বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছি। মামলা চলমান। এরই মধ্যে আবার তদন্ত শুরু হচ্ছে। এ অবস্থায় কোন মন্তব্য করছি না।’
কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন সরকার বলেন, ‘তদন্তের জন্য চিঠি আমি রবিবার পেয়েছি। আজই (সোমবার) প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। আমাকে ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দেব।’
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন