জিম্বাবুয়ের সেনা অভ্যুত্থানের নেপথ্যে চীন?
জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে গৃহবন্দি করে রাখার ঘটনাটিকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখছে আফ্রিকান ইউনিয়ন। বৃহস্পতিবার বিভিন্ন আন্তজার্তিক সংবাদমাধ্যম মুগাবে উৎখাতের এই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদিনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র চীনের ভূমিকার প্রশ্নকে সামনে এনেছে। ঘটনা পরম্পরা আর রাজনীতি বিশ্লেষকদের বরাতে সংবাদমাধ্যম বলছে, জিম্বাবুয়েতে সংঘটিত অভ্যুত্থানে সে দেশের বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ চীনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদিকে অভ্যুত্থানের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনী।
বিশ্বে জীবিত প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবথেকে বেশিদিন ক্ষমতায় রয়েছেন মুগাবে। এখন তিনি রাজধানী হারারেতে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দি। সেনাবাহিনী হারারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাকে গৃহবন্দি করে ।তবে ঘটনাটিকে অভ্যুত্থান বলতে নারাজ দেশটির সেনাবাহিনী। মুগাবের চারপাশে থাকা ‘অপরাধীদের’ উৎখাত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি তাদের।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ এক প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে। এনবিসির খবর অনুযায়ী সেনাবাহিনী চাইছে ৯৩ বছরের মুগাবে যেন নীরবে পদত্যাগ করেন। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সামর্থ্যসম্পন্ন কারও কাছে রক্তপাতহীন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, মুগাবে বা তার ৫১ বছরের স্ত্রী গ্রেস এখনও ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হননি।
এনবিসি ও গার্ডিয়ান পৃথক পৃথক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগেই অভ্যুত্থানে জড়িত থাকা এক জেনারেল ও সেনা প্রধান কনস্টানটিনো চিওয়েঙ্গা চীন সফরে গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন জানিয়েছে, সেনা প্রধানের এই সফর ছিল স্বাভাবিক সামরিক বিনিময়ের অংশ।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি যখন মুগাবের সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন চীন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বৈরাচারি শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও চীন মুগাবেকে সমর্থন করে গেছে। জিম্বাবুয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী চীন। ২০১৫ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জিম্বাবুয়ে সফর করেছিলেন। ওই সময় শি বলেছিলেন দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীর। সফরে ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
অভ্যুত্থানের পরদিন বৃহস্পতিবার চীন জানিয়েছে, জিম্বাবুয়ের অনিশ্চয়তার প্রতি তাদের গভীর মনোযোগ রয়েছে এবং আফ্রিকার দেশটির প্রতি তাদের বন্ধুত্বের নীতি অটল থাকবে। সংকটের কারণে এই নীতিতে পরিবর্তন আসবে না। জিম্বাবুয়ের সেনা প্রধান চীন সফরে অভ্যুত্থানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন কিনা জানতে চাইলে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুসারে, চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) জয়েন্ট স্টাফ লি ঝোশেং জিম্বাবুয়ের সেনাপ্রধানকে বলেন, চীন ও জিম্বাবুয়ে সব সময়ের বন্ধু। জবাবে চিওয়েঙ্গা জানান, সবক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বিনিময় ও সহযোগিতা গভীর করতে চান। এই বৈঠকের দুদিন পর জেনারেল চিওয়েঙ্গা বৈঠক করেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল চ্যাং ওয়ানকুয়ানের সঙ্গে। এসময় তিনি চীনের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান।
জিম্বাবুয়ের সেনাপ্রধানের চীন সফরের কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও আভাস মেলেনি কোথাও। তবে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বহিষ্কৃত ভাইস-প্রেসিডেন্ট এমারসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানা গেছে আল জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আফ্রিকার ইতিহাস ও রাজনীতির প্রভাষক মাইলস ব্লেসিং টেন্ডি মনে করেন, মুগাবের ভাগ্য সম্পর্কে চীন আগে থেকেই জানত- তা নিশ্চিত হয়ে বলার উপায় নেই। তবে তিনি মনে করেন, সার্বভৌমত্বের প্রতি চীনের শ্রদ্ধা থাকার কারণে অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা প্রচলিত ধরনের হবে না। মাইলস বলেন, ‘অভ্যুত্থান যেখানে অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয় চীন সেখানে সবসময়ই স্থিতিশীলতার কথা বলে। ফলে দৃশ্যত মনে হয় না অভ্যুত্থানের সঙ্গে চীন জড়িত। এ ধরনের কোনও কিছুর পরিকল্পনা গোপনেই হয়। কেউ প্রকাশ্যে তা স্বীকার করবে না। ফলে অভ্যুত্থানে চীনের সংযোগ আছে কিনা, নিশ্চিতভাবেই আমরা তা প্রমাণ করতে পারব না।’
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ের অধ্যাপক টেডি ব্রেট মনে করেন, জিম্বাবুয়ের ক্ষমতায় যিনিই থাকুন না কেন তাকে বিদেশ-নির্ভর হতেই হবে। এক্ষেত্রে চীনকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি মনে করেন তিনি। ‘তারা যদি চীনের সহযোগিতায় শাসন শুরু করে আমি খুব একটা অবাক হবো না। গণতন্ত্রের আশ্বাস না দিয়েই তা ক্ষমতা চালিয়ে যেতে পারে। চীন সব সময় ক্ষমতায় থাকা শক্তিকে শর্তহীনভাবে সমর্থন জানিয়েছে। নিবার্চিত বা অনির্বাচিত সরকারই হোক না কেন চীন সমর্থন জানিয়ে আসছে।’ বলেন টেডি ব্রেট।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি যখন মুগাবের সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন চীন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বৈরাচারি শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও চীন মুগাবেকে সমর্থন করে গেছে। জিম্বাবুয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী চীন। ২০১৫ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জিম্বাবুয়ে সফর করেছিলেন। ওই সময় শি বলেছিলেন দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীর। সফরে ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
বৃহস্পতিবার চীন জানিয়েছে, অভ্যুত্থানজনিত সংকটের কারণে জিম্বাবুয়ের প্রতি তাদের বন্ধুত্বের নীতিতে কোনও পরিবর্তন আসবে না। অধ্যাপক ব্রেট মনে করেন, চীন এখন অপেক্ষা করবে ক্ষমতায় কে আসছে তা দেখার জন্য। তিনি বলেন, “যখন ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যাবে তখন তারা বলবে ‘এসব ঘটনা জিম্বাবুয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়’। এমনটি যদি না হয় তাহলে আমি অবাক হব।”
দক্ষিণ আফ্রিকার এক অ্যাকাডেমিক ও সাংবাদিক কোবাস ভ্যান স্ট্যাডেন চীন-আফ্রিকা সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। তিনি জানান, মুগাবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে চীনের কোনও ভূমিকা রয়েছে কিনা তা জানা অসম্ভব। বলেন, আসলে কী ঘটছে তা কেউ জানে না। তবে সেনাপ্রধানের চীন সফরের সময় সন্দেহজনক।
মুগাবের ৩৭ বছরের শাসনের অবসান হওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার চীনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরেও বেইজিং-এর সন্তোষেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন সে দেশের বিশ্লেষকরা। অবশ্য চীনা অর্থায়নে পরিচালিত সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক এক প্রতিষ্ঠানের আফ্রিকা বিশেষজ্ঞ শেষ শিয়াউলেই জিম্বাবুয়ের অভ্যুত্থানে চীনের ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, চিওয়েঙ্গার সফর অনেক আগেই ঠিক করা ছিল। ফলে অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা করতে তিনি চীন সফর করার বিষয়টি অসম্ভব।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন