জীবন সংগ্রামের গল্প শোনালেন তিন নোবেলজয়ী নারী

নারী যখন অধিকারের কথা বলছে, তখন সেটি তার হয়ে অন্য কেউ বলে দেবে; সেই অপেক্ষা না করে তার কথা তাকেই বলতে পারতে হবে। নারীর জীবন সংগ্রামের জায়গায় সহযোগিতামূলক উপস্থিতি থাকবে কিন্তু দৃঢ়তা অনেক বেশি জরুরি। যেটা করতে চায় সেটির পক্ষে টিকে থাকাটাও লড়াইয়েরই অংশ।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইরানের শিরিন এবাদি, ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান ও যুক্তরাজ্যের মেরেইড ম্যাকগুয়ের তাদের জীবন ও সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে এসব কথা বলেন। তারা মনে করেন, শান্তি ও অহিংস পথে সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু ফল পাওয়া যাবেই। মানবাধিকারকর্মীকে তার আন্দোলনে সারাজীবনই অন্যকে সহযোগিতার বিষয়টি ভাবতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। আজ বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) নারীপক্ষের আয়োজনে ‘জীবন ও সংগ্রামের পথে’ অনুষ্ঠানে তিন নোবেলজয়ী তাদের সংগ্রামের পথ তুলে ধরেন হলভর্তি দর্শকের সামনে।
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চিকে সত্য প্রকাশ করার আহ্বান জানান শান্তিতে নোবেল জয়ী যুক্তরাজ্যের মেরেইড ম্যাকগুয়ের। তিনি বলেন, ‘রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ আরও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও কীভাবে সু চি চুপ করে আছেন। তিনি সত্যটা বলুন, বিশ্ব তার পাশে দাঁড়াবে।’
শান্তি ও অহিংসার জন্য কাজ করছেন মেরেইড। বাংলাদেশে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সারাবিশ্বের সহিংসতা দেখতে দেখতে যখন প্রশ্ন করি, বিশ্বে আশান্বিত হওয়ার কিছু কি আদৌ আছে? তখনই দেখতে পাই ১০ লাখ রোহিঙ্গার পাশে কীভাবে বাংলাদেশ দাঁড়ায়।’ আয়ারল্যান্ডের এথনিক সমস্যার কথা তুলে ধরে মেরেইড বলেন, ‘কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যলঘুদের কথা শুনতে চায় না।’ পরিবারে ঘটে যাওয়া একাধিক কষ্টের ঘটনাও তাকে তার কাজ থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি উল্লেখ করে মেরেইড বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আপনাকে শেয়ার করতে হবে, কম্প্রমাইজ করতে হবে এবং অপরকে শুনতে হবে। আমি পরিবারের সদস্য হারিয়ে বুঝেছি, জীবনে চলার পথটা একে অপরকে সহায়তা করে এগিয়ে যাওয়ার। ভোগান্তির অন্যদিকেই আছে আনন্দ। ভোগান্তির সময়গুলোকে মানবিকভাবে বুঝতে পারলে ভোগান্তির সময় শেষ হয় আনন্দের যাত্রার মধ্য দিয়েই।’
বক্তব্য রাখছেন শিরিন এবাদিনোবেলজয়ী আরেক নারী শিরিন এবাদি তার জীবনের লড়াই সম্পর্কে বলেন, ‘১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে গণতন্ত্রের নামে চরম অগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। ইসলামের নামে যে পরিবর্তনগুলো এলো, সেগুলো নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। ইরানে পাথর ছুড়ে মারার শাস্তি আছে, হাত কেটে ফেলার নিয়ম আছে। বাংলাদেশও মুসলিম দেশ; এখানে এমন কোনও নিয়ম তো নেই। নারীর জীবনের মূল্য পুরুষের অর্ধেক! তারা বলে, দুজন নারী সাক্ষীর সমান একজন পুরুষ সাক্ষী।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন কথা বলা শুরু করি, আমাকে থামানোর হেন চেষ্টা নেই করা হয়নি। আমাকে কাজের জায়গা থেকে বাদ দেওয়া হয়। আমি থামিনি। এরপর আমি রাজনৈতিক ও আদর্শিক কারাবন্দিদের নিয়ে কাজ শুরু করি। আমি দেশে-বিদেশে পুরস্কার পেতে শুরু করি আমার কাজের কারণে। আমি যত বেশি খ্যাতিলাভ করতে থাকি, সরকার ততই বিগড়ে যেতে থাকে। আমার অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমার কলিগদের জেলে পুরে তারা। সেসময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ঘটনার পর আমি যখন ইরানে ফিরতে চাই, সহকর্মীরা আমাকে নিষেধ করেন। তারা বলেন, আমি যদি দেশের বাইরে থাকি আমার কণ্ঠরোধ হবে না। বিশ্ব আমার কথা শুনবে। আমার স্বামী ও বোনকে গারদে পুরে দেওয়া হয়। বলা হয়, আমি চুপ করে গেলে তারা মুক্তি পাবে। আমার উত্তর ছিল: আমি তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসি কিন্তু আমি সত্যকেও ভীষণ ভালোবাসি। এরপর সরকার আমার সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে বলে, আমি যদি চুপ করি, সব ফিরিয়ে দেবে। আমি বলি, আমার ওসব দরকার নেই। আমার কথা কাজ আমি চালিয়ে যাই।’
ইরানের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স ৩০ এর মধ্যে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বেকারের সংখ্যা বেশি; মানুষ স্বাধীনতা চায়, যা তাদের নেই। কিন্তু ইরানের যা আছে, তা দিয়েও ভবিষ্যত গড়া সম্ভব। আমি এখনও আশাবাদী, ইরানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।’
ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান সাংবাদিক ছিলেন। তিনি সেখানকার নারীদের নিয়ে কীভাবে সভা করতেন, কীভাবে তাদের সঙ্গে অধিকারের বিষয়ে আলাপ করতেন তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্য থেকে আরব দেশের লড়াই, ইয়েমেনের লড়াই, আমার লড়াই। একসময় ইয়েমেনের নারীরা বলেন, অনেক হয়েছে। তারা বেছে নেয় শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের পথ। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একমাত্র পথ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি সাংবাদিক ছিলাম। লিখতে শুরু করি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। আমি সংগঠন করব, সরকার তার লাইসেন্স দেবে না। আমাদের চুপ করাতে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমরা বললাম, লাগবে না লাইসেন্স। যেকোনও আঘাতে আমরা পথে নেমেছি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চেয়ে। যখন রাস্তায় নেমেছি, তখন সরকার এমন কোনও পদক্ষেপ ছিল না গ্রহণ করেনি। কিন্তু আমরা ফুল উচিয়ে শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের পথেই থেকেছি।’
শুরুতে নারীপক্ষের সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শিরিন হক পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশের বন্ধু সদ্যপ্রয়াত আসমা জাহাঙ্গীরকে স্মরণ করে বলেন, ‘আসমা সেই বন্ধু, যিনি উইমেন অ্যাকশন ফোরামের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় কাণ্ডের জন্য ক্ষমা চান, যা পাকিস্তান দেশ হিসেবে আজও চায়নি।’ এসময় তার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের পক্ষ থেকে তিন নোবেলজয়ী নারীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। এরপর নারীপক্ষের পক্ষ থেকে তাদের হাতে ক্রেস্ট ও উত্তরীয় তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন সংগঠনের নারী আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তিন নোবেল বিজয়ী তাদের কথা তুলে ধরেন।
এসময় নেকাব ও হিজাবের বিষয়ে তাদের চিন্তার কথা জানতে চাইলে শিরিন এবাদি ও তাওয়াক্কল উত্তর দেন। তারা দুজনেই মনে করেন, নেকাবকে নিরাপত্তার জন্যই এখন হুমকি বলে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু একজন নারী তার মুখ ঢাকবেন, হিজাব পরবেন বা পরবেন না–এটা একেবারেই তার স্বাধীনতা। সে যেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সেই সিদ্ধান্ত একান্ত তার। সমস্যাটা তখনই হয় যখন এ ধরনের বিষয়েও জোরজবরদস্তি করা হয়।
তিন জনই সিরিয়ায় ঘটে চলা অন্যায় বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সেখানে যা হচ্ছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন



















