জেনারেল মইনকে বিদায় করেছিলেন প্রণব মুখার্জী
নঈম নিজাম : প্যান্ডোরার বাক্স খুললেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। আত্মজীবনীমূলক লেখা বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’-এ বাংলাদেশের রাজনীতির অজানা তথ্য তুলে ধরলেন তিনি।
প্রণব মুখার্জির এই বই প্রকাশের কথা আগেই শুনেছিলাম। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার পরই আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। দিল্লির রাজাজি রোডে নতুন বাড়িতে মাত্র উঠেছিলেন তিনি। সবকিছু গোছানোও শেষ হয়নি। তখনই আমাকে সময় দিলেন। দীর্ঘ এক ঘণ্টা গল্পের ভাণ্ডার খুলেছিলেন।
শুরুতেই কথায় কথায় জানালেন, আমি যাওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি পড়ছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি। বইটি আগেও পড়া ছিল। অনেক দিন পর আবার শুরু করেছেন। আমি বললাম, এত দিন অনেক ব্যস্ত ছিলেন। এখন অবসর সময়গুলো বই পড়ে কাটবে আপনার।
তিনি বললেন, আমি লিখছি। আত্মজীবনীর বাকি অংশ প্রকাশ হবে দ্রুত। সেই বইটি এই মাসের শুরুতে প্রকাশিত হলো দিল্লিতে। যা নিয়ে চলছে আলোচনা। আমাদের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সানের সম্পাদক ইনামুল হক চৌধুরী দিল্লি গিয়েছিলেন গেল সপ্তাহে। তিনি আমার জন্য বইটি নিয়ে আসেন। পড়া শুরু করেছি বইটি।
ভারতের রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব প্রণব মুখার্জি অনেক কিছুই খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন তার এই নতুন বইতে। বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে তার ভূমিকা ও অবস্থানের কথা কোনো রাখঢাক না রেখেই তুলে ধরেছেন। আমরা জানি, বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন অধ্যায়ে প্রণব মুখার্জির ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতেও তার অবস্থান কম যায় না। বেনজির ভুট্টো এবং নওয়াজ শরিফের সঙ্গেও তার গভীর সখ্যের কথাও তিনি আমাকে বলেছিলেন। প্রণব মুখার্জি অসুস্থ থাকাকালে নওয়াজ বার বার হাসপাতালে ফোন করেছেন। খোঁজ নিয়েছিলেন। তখন ফোনে তিনি প্রণব মুখার্জিকে বলেছিলেন, আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তিকে সহায়তা করার জন্য।
একসময় বেনজির এভাবেই তার সঙ্গে কথা বলতেন। এখন বলছেন নওয়াজ। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে পাকিস্তানের এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার গভীর যোগাযোগ ছিল। শুধু পাকিস্তান নয়, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতেও প্রণবের প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের কথা আমরা শুনেছি। এবার জেনেছি তার এই বই পড়ে। তবে বইয়ের বাইরে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে।
সর্বশেষ সাক্ষাতের সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে ঢাকা সফরের কথা। এ সময় বঙ্গভবনে জিয়া তার জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করেন। যাতে বেগম জিয়াও উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। জিয়া-খালেদার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি বাগেরহাটে এটাও প্রণব মুখার্জির এখনো স্মরণে রয়েছে।
প্রণব মুখার্জির বই পড়ে পাঠকরা বুঝতে পারবেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা। দুঃসময়ে তিনি কীভাবে দলমতনির্বিশেষ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি কীভাবে কাজ করেছেন। আমার এখনো মনে আছে, ওয়ান-ইলেভেনের শাসনকালে কলকাতায় আমাদের অনেক রাজনীতিক বন্ধু পালিয়ে ছিলেন।
আমি মাঝে মাঝে তাদের ফোন দিতাম। তারাও ফোন করতেন। কথা হতো। বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থা আমার কাছ থেকে তারা জানতেন। এই সময়ে কলকাতায় বাংলাদেশের আরও দু-এক জন প্রিয় বন্ধু কাজ করেছেন। দুঃসময় হলে তারা নীরবে কাজ করে যান বাংলাদেশের জন্য। অথচ তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। সেই সময়ে আগরতলা সীমান্তে থাকতেন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম। তাদের সঙ্গে কথা হতো ফোনে।
সীমান্তে থাকার কারণে তারা বাংলাদেশের মোবাইল সিম ব্যবহার করতেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা মনে করতেন তারা দেশে পালিয়ে আছেন। আলাউদ্দিন নাসিম ও তাদের কাছে তখন শুনেছিলাম প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার নিয়মিত কথা হতো। প্রণবদা শেখ রেহানাকে আশ্বস্ত করতেন চিন্তার কারণ নেই। তিনি সব দেখছেন।
আলাউদ্দিন নাসিম আর শামীম ওসমান বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। শামীম ওসমান কানাডা ছেড়ে চলে আসেন ভারতে। একবার প্রণব মুখার্জির দুই পা ধরে শামীম ওসমান চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। আর বলতে থাকেন, দাদা আপনি যেভাবে পারেন আমাদের নেত্রী, আমাদের আপাকে বাঁচান। তারা মেরে ফেলেছে নেত্রীকে। প্রণব মুখার্জি বিস্ময় নিয়ে তাকান শামীমের দিকে। এবার শামীম বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি দাদা কাল রাতে। আপনি খোঁজ নিন।
প্রণব মুখার্জির ওসব তত্পরতার কথা লোকমুখে শুনেছিলাম। আমিও দাদাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম বিভিন্ন সময়। এখন আর কারও মুখে নয়, সব প্রশ্নের জবাব রয়েছে তার ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইতে। তিনি লিখেছেন, কোন অবস্থায় জেনারেল মইনকে দিল্লিতে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে তিনি কী ভূমিকা রেখেছিলেন।
কোন পরিস্থিতিতে যোগাযোগ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সারা বিশ্বে কীভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন ও দুই নেত্রীর মুক্তির জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একটা শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দিকে জোর দিয়েছিলাম।’
তিনি আরও লিখেছেন, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। এ সময় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জেনারেল মইন।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে, শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিই এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তার বহাল থাকার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করি।’
এ ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে তার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাক্ষাৎ চাই। তৎকালীন ভারতের জাতীয় উপদেষ্টা এম কে নারায়ণের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে আমি সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম।’
প্রণব মুখার্জি আরও লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির মাধ্যমে ভারত তার দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা কারাগারে থাকার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা তাকে পরিত্যাগ করলে আমি তাদের ভর্ত্সনা করে বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে, তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় পান।’
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির এই লেখা বিভিন্ন মহলে আলোড়ন তুলেছে। আমায় সরকারি দলের এক বন্ধু বললেন, এই মুহূর্তে বইটি প্রকাশ না হলে ভালো হতো। মাওলানা আজাদের মতো এই পৃষ্ঠাগুলো ১০ বছর পর বের করতে পারতেন তিনি। আমি তাকে বললাম, ইতিহাসের অনেক কিছু আমাদের অজানাই থেকে যেত। প্রণব মুখার্জি সঠিক কাজ করেছেন। আমরা সঠিক ইতিহাস জানতে চাই— শুধু ওয়ান-ইলেভেন নয়, সব বিষয়ে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে অনেক দিন আগের আরেকটি কথা। একবার নিউইয়র্কে দীর্ঘ আড্ডায় বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খানকে বলেছিলাম, দাদা আপনি লিখছেন না কেন? কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আপনারা নিউক্লিয়াস করলেন? মুজিববাহিনী করলেন? স্বাধীনতার পর জাসদ করলেন— সব মানুষকে জানাতে হবে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিন আপনি দিল্লিতে ছিলেন। ঢাকায় ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে আপনি এক দিনের জন্যও আটক হননি।
জরুরি অবস্থা জারির পর বঙ্গবন্ধু আপনাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘সিরাজ তোকে ওরা বাঁচতে দেবে না। চলে যা।’ আপনি বাংলাদেশ ছাড়লেন। ইতিহাসের এই অজানাগুলো প্লিজ লিখুন। বলুন। আপনি চাইলে আমি লোক দেব। আপনি বলবেন, আমার লোক লিখবে। তিনি আমার কথার জবাব দেননি। এখনো লেখেননি কিছু। কোনো দিন লিখবেন কিনা জানি না।
প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। ১৯৭১ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের এই অজনা অধ্যায় আমাদের জানা দরকার ছিল। কারণ এ নিয়ে অনেক গল্প শোনা যেত। বাস্তবে ভারতের কী ভূমিকা ছিল তা দেশবাসীর কাছে এখনো অজানা।
ওয়ান-ইলেভেনের আগের দিন জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে কোন রাজনীতিকদের কথা হয়েছিল? বারীরা কার নির্দেশ শুনেছিলেন তা বের হওয়া দরকার। কয়েক বছর আগে আমেরিকায় অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার বারীকে আমি ফোনে বলেছিলাম আত্মজীবনী লিখতে। ওয়ান-ইলেভেনের মূল নায়কদের বারী একজন।
সেনাপ্রধানের লেখায় সবকিছু উঠে আসেনি। অনেক কিছু এখনো রয়ে গেছে বাকি। বারী আমাকে বললেন, মুখ খুলব। সব কথা বলব। লিখব। আমি তার এই বক্তব্য বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠকদের জানিয়েছিলাম। এর পর থেকে বারীর আর খোঁজ নেই। তিনি হাওয়া।
প্রণব মুখার্জির বক্তব্যের পর আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। সেদিন ওয়ান-ইলেভেনকে কারা সমর্থন দিয়েছিল প্রথম? অভিনন্দন কারা জানিয়েছিল? আজ অনেক মানুষ ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু এত দ্রুত বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে একটি ইতিহাস আরেকটিকে টেনে আনে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে আসল সত্য। ওয়ান-ইলেভেনে শুনেছিলাম, ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর টাকার শেষ নেই। এখন শুনি চিকিৎসার অভাবে তিনি ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাচ্ছেন। প্রকৃতি বড় রহস্যময়। এই রহস্য ভেদ করা জটিল। যে ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে এত কথা সেই সময়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেওয়া ১২৫০ কোটি টাকা তারা এখনো ফেরত পাননি। এমনকি আদালতের নির্দেশের পরও।
ওয়ান-ইলেভেন দেখিয়ে কত রাজনীতিবিদের সর্বনাশ হয়েছে তার শেষ নেই। আবার কতজন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ নয়, বটগাছ হয়েছেন তাও দেখছি। আসলে যে কোনো বিষয়ে একটা অসিলা লাগে। এই অসিলার সত্য-মিথ্যা আমরা যাচাই-বাছাই করি না। করি না বলেই ড. আওলাদদের সর্বনাশ হয়। থেকে যায় অনেক কিছু অজানা। -বিডি প্রতিদিন
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন