টিভি সাংবাদিকতায় নতুন ধকল
সংবাদপত্রের পর দেশের টেলিভিশনগুলোও এখন আচ্ছারকমের ভোগান্তিতে। এ প্রধান কারণ বিজ্ঞাপন স্বল্পতা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজ্ঞাপনই টেলিভিশনগুলোর আয়ের একমাত্র খাত। সেখানে এখন চরম খরার টান। প্রযুক্তির লড়াইও ব্যাপক। মোবাইল ফোনের তোড়ে স্টিল ক্যামেরা কাবু হয়ে গেছে কবেই। ভিডিও ক্যামেরাও টিকে থাকার লড়াইয়ে পর্যদস্তু।
টেলিভিশন সাংবাদিকতায় একটা সম্ভাবনা দেখা দিলেও সেটা ধপাস কড়ে পড়তির দিকে। টিভিগুলোকে অনেকে সরকারি প্রচারমাধ্যম বলে থাকেন। এক ধরনের আদিষ্ট হয়ে সংবাদ পরিবেশন ও সংবাদকর্মী নিয়োগ হওয়ায় এর বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। টিভি চ্যানেলগুলোতে এখনো বেতন কাঠামো তৈরি হয়নি। যাদের একটু নাম আছে তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা বেশি। টেলিভিশন মিডিয়ার দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভেঙে সিটিজেন জার্নালিজম, নেট জার্নালিজম, মোবাইল জার্নালিজন। বিকশিত হবার আগেই এ টার্মগুলো ছড়িয়ে গেছে দ্রুত। হালসময়ে ফেসবুক এবং ইউটিউব জার্নালিজমের দাপট। মানুষের কাছ যে মাধ্যম সবচেয়ে সহজলভ্য সেটিই আদরণীয়।
পত্রিকার পাতা উল্টানোর ঝামেলা থেকে বাঁচতে মানুষ রিমোর্ট টিপে টিভি ঘুরিয়েছে এখন। টেলিভিশন চ্যানেলের শিডিউলের কাছে বন্দি না থেকে ঝুঁকছে ইউটিউব এবং ফেসবুকে। কারণ এখানে কোনো শিডিউল নেই, ধরাবাঁধা সময় নেই, এক বছর আগের তথ্যটিও তারা খুব সহজে ফেসবুক-ইউটিউব থেকে খুঁজে নিচ্ছেন।
উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিনের রেল ভারতীয় উপমহাদেশে আসতে সময় লেগেছে অন্তত ৪০ বছর। কিন্তু ১৯৯০-এ আবিষ্কৃত ইন্টারনেট বাংলাদেশ ভারতে পৌঁছে যায় দু-তিন বছরের মধ্যেই। ২০০৭ এ আইফোন আসে আমেরিকার বাজারে। এর ৩-৫ বছরের মধ্যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তৈরি স্মার্টফোন পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে। উন্নত বিশ্বের মানুষ যেসময় স্মার্টফোনে গুগল ম্যাপস ব্যবহার করার সুযোগ পায়, বাংলাদেশের ব্যবহারকারীর কাছেও তা সেই একই সময়েই উন্মক্ত হয়। এখন আর দশকের পর দশক সময় পেরিয়ে যায় না নতুন আবিষ্কার পেতে।
মূলধারার গণমাধ্যম এতদিন শুধু বার্তা দিয়ে গেছে। অন্যপক্ষ থেকে শোনার বা জানার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন একটি সংবাদ যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুবের মাধ্যমে আরও বেশি অডিয়েন্সের খাচে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। অনেক ঘটনাই মূলধারার গণমাধ্যমে আগে প্রকাশিত হয়নি। ফেসবুকে ব্যাপক লেখালেখির কারণে শেষ পর্যন্ত মূলধারার গণমাধ্যম সেটিকে তাদের এজেন্ডায় নিয়ে আসেত বাধ্য হয়। আসলে প্রচলিত গণমাধ্যমে-সাংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন সব মাধ্যমকেই লড়তে হচ্ছে নানা ফ্রন্টে। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং সর্বশেষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যে বিশাল চ্যালেঞ্জে ফেলেছে তা বৈশ্বিক ঘটনা। এটি কারো জন্য সমস্যার। কারো জন্য সম্ভাবনারও।
মানুষ কোন মাধ্যমে বা প্ল্যাটফর্মে গ্রহণ করবে সেটা যার যার বিষয়। মোবাইল ফোন এখন বিশ্বের এক নম্বর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। মোবাইল অডিয়েন্সকে সামনে রেখে সংবাদক্ষেত্রের চেহারাও পাল্টে যেতে বসেছে। সাংবাদিকতা আর শুধু লেখা বা বলা কিংবা দেখানোতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। তারওপর গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে। রাষ্ট্রিয় নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলোর নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। সেন্সরশিপের পদ্ধতিটি এখন আগের ছেয়ে বেশি পরিশীলিত। শাসকরা আইনানুগ পক্রিয়ায় এগোতে আগ্রহী। আইনগুলো আগের তুলনায় কঠোর, এই আইনগুলোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরো কঠোর। এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্টভাবে রাখা হয় এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেন ইচ্ছামতো ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দেয়। সাংবাদিকেদেরই ঠিক করে নিতে হচ্ছে কোথায় তার সীমানা।
রাষ্ট্রের চরিত্রের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলোর চরিত্রও বদলে যায়। মিডিয়া বাংলাদেশে যেমন খুব দ্রুত প্রসারিত ও আধুনিকতর হয়েছে, তেমনি এর পরিবেশনের চরিত্রও আমূল পাল্টে গেছে। গত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশে প্রিন্ট ও ব্রডকাস্ট মিডিয়া জগতে সংবাদ পরিবেশনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন যেমন পরিবেশনার কলা কৌশলে, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে, তেমনি সংবাদ পরিবেশণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শনেও। খোদ মার্ক জুকারবার্গ ফেসবুকে ‘ভ্রান্ত খবর’ বিষয়ে সতর্ক করে ব্যক্তিগত টাইমলাইনের সংবাদকে প্রাধান্য কম দেওয়ার ঘোষনা দিলেও বাস্তবটা উল্টো। বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংবাদ এবং তথ্যগুলোর কোনো দায় নেই। এর কোনো বিশ্বস্ত তথ্য উৎসও নেই। সম্পাদকীয় দায় নেই। কিন্ত প্রচার-প্রসার যা হবার হয়ে যায়।
মূলধারার সাংবাদিকরা যে সেকল বিষয় তুলে আনতে পারেন না, এমন অনেক বিষয় সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ‘পোস্ট’ বা ‘স্ট্যাটাস’। এগুলো পোস্ট স্ট্যাটাস যে নামই হোক, সত্য-আধাসত্য, মিথ্যা যাই হোক সেগুলোও তথ্যমূল্য পাচ্ছে। এতে ফেসবুক ইতোমধ্যে বিকল্প মিডিয়া হয়ে প্রতিটি মানুষ এখন ইনডিভিজ্যুয়াল সাংবাদিক বানিয়ে দিচ্ছে। একজন পেশাদার সাংবাদিক অনেক সময় যা পারেন না। ফেসবুকাররা সেটা করে দিচ্ছে গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভিডিও ফুটেজটি ছিল পাশের এক ভবন থেকে এক কোরীয় নাগরিকের তোলা এবং ফেসবুকেই সেটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, যা মুহূতেই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে এটি সংবাদ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
কুমিলল্লায় তনু হত্যা, ঢাকায় দিনে দুপুরে রাস্তায় কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা, বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা, সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজাকে কুপিকে হত্যার চেষ্টা, চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের স্ত্রী মিতু হত্যা এরকম আরও অনেক আলোচিত বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই সাধারণের নজরে এসেছে। মূলধারার সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল সেই সংবাদগুলো ফেসবুক থেকে নিতে হচ্ছে। মূলধারা সাংবাদিকাতর ওপর অনেকব ধরনের চাপ বিদ্যমান থাকে, তা যেমন সরকারের তেমনি মালিকপক্ষের। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সে রকম কোনো চাপের মোকাবেলা করতে হয় না বলে। তারা সেন্সরমুক্ত তথ্য প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় মূলধারার প্রিন্ট বা ইলেকট্রিনিক মিডিয়াগুলোকে এখন নিজেরও ফেসবুক পেজ খুলতে হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের বিপরীতে ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতি সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীদের বড় সুবিধা হলো এখানে তেমন কোনো অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় না। ব্যাবহারকারীদেরও অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় না। ফেসবুককে ঘিরে ভুয়া খবরসহ নানা অভিযোগরে পরও ফেসবুকের আয় ও ব্যবহারকারীর হার তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। সিটিজেন জার্নালিজম অন্তত তাই বলে। সিটেজেন জার্নালিজম মূল জার্নালিজমের পরে যে ক্ষেত্রকে কঠিন করে দিয়েছে। অনলাইন জার্নালিজমের পরে যে ক্ষেত্রটি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম। যা মূলত অনলাইন জার্নালিজমের একটি বর্ধিত অবয়ব। অনলাইন জার্নালিজম বলতে বোঝাতো শুধু নিউজ পোর্টালগুলোকে। ইউটিউবসহ অন্য মাধ্যমগুলোকে খুব একটা গোনায় ধরা হতো না। অথচ এখন ইউটিউব তথ্যের জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখচে। সাক্ষাৎকার, এক্সক্লুসিভ ক্লিপ থেকে ডেইলি ইভেন্টও উঠে আসছে ইউটিউবের মতো মাধ্যমে।
লেখক:
নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আপন আলো;
সদস্য, ডিইউজে
ও
জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশক
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন