টেস্টি স্যালাইন দিয়েই ইফতার করেন রহিমারা!

দুঃখ-কষ্ট আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন এক মা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে সন্তানের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাজের কিছু কা-পুরুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়াও বেঁচে থাকার পথ। কিন্তু অভাব তাদের পিছু ছাড়ে না। এদের জীবনে ঈদ বা উৎসব বলে কোন কথা নেই।

বলছি রহিমা বেওয়ার (৬৫) গল্প। দুই সন্তানের জননী রহিমা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা রায়পুর ইউনিয়নের বাকসিড়ি এলাকায় মৃত খাতিবর রহমানের স্ত্রী। গত চার বছর আগে স্বামী খাতিবর অসুস্থতা জনিত কারণে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু বরণ করেছেন। এরপর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংসারের হাল ধরেন রহিমা। মানুষের বাড়িতে, অনেক সময় মানুষের কৃষি খামারে কাজ করে যা উপার্জন করেন তা দিয়েই চলে যায় সংসার। ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা ভাবে থাকে। এখন একমাত্র প্রতিবন্ধী মেয়ে বেগমকে (২৮) নিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন রহিমা।

রমজান মাসে কী দিয়ে ইফতার করেন এমন প্রশ্ন করতেই আক্ষেপ প্রকাশ করে রহিমা বলেন, ‘গরিবের আবার ইফতার! নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে তিন বেলা খাবার কেনাই কষ্টকর! ভালো ইফতারি কেনার সাধ্য তো আমার কখনো হয়নি। টেস্টি স্যালাইন পান করেই ইফতার করছি এবার। বড়লোকদের মত বাহারী ইফতার কখনো খাওয়া হয় না আমাদের মত গরিব পরিবারগুলোর।

রহিমা আরো বলেন, ‘জীবন মানে যুদ্ধ’ সেটি বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পরে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ হচ্ছে না। প্রতিদিনই দু’মুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করেই যাচ্ছি। কিন্তু অভাব তো পিছু ছাড়ছে না। যেদিন অসুস্থ থাকি মা ও প্রতিবন্ধী মেয়ে নিয়ে অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটাতে হয়। মনে করেছিলাম ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কপালটা খারাপ সে বিয়ের পর বউকে নিয়ে পর হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে ছিলাম, কিন্তু অভাবের কারণে জামাই বেশিদিন রাখেনি। এখন মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টের মাঝে দিন পার করছি। রমজান মাসে রোজা রাখছি মা, মেয়ে সেহেরিতে দু’মুঠো ভাত খেয়ে। পরেদিন কাজ করে যা উপার্জন করি তা দিয়ে আবার বাজার থেকে চাল কিনে আনি। সারাদিন ক্লান্তির পর টেস্টি স্যালাইন দিয়েই ইফতার করে ফেলি। কখনো মেয়েটিকে ঈদে কাপড় চোপড় কিনে দিতে পারিনি।

শুধু রহিমার জীবনে রমজান মাসে কষ্ট করে টেস্টি স্যালাইন দিয়ে ইফতার করেন সেটি না। ঠাকুরগাঁওয়ে গ্রামাঞ্চলের হতদারিদ্র মানুষের শুধু রমজান মাস নয়, নিত্যদিনের ঘটনা এটি।

ঠাকুরগাঁও জেলায় ৮০ ভাগ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৭০ ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলয়ে। গ্রামের মানুষের জীবন যাত্রায় ঈদ বা কোন উৎসবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। ফলে সমাজের একটা বড় অংশই ঈদ বিনোদনের বাইরে থেকে যায়।

ঠাকুরগাঁওয়ে দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিতের কারণে কখনো গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে রমজান মাস বা ঈদ উৎসব বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসতে পারে না। অর্থের অভাবে নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারেনা খেটে খাওয়া নানা পেশার মানুষ। সামান্য সেমাই-চিনি কিনতে গিয়েই তাকিয়ে থাকতে হয়েছে স্থানীয় মুদি দোকানদারদের মুখের দিকে।