দলীয় বিশৃঙ্খলা রোধে তারেক রহমানের ‘স্মার্ট অ্যাকশন’
আন্দোলন-সংগ্রামের নানা ধাপ পেরিয়ে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। গত ১৭ বছর ধরে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটাতে রাজপথে সোচ্চার ছিল বিএনপি। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ আওয়ামী শাসনামলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। আর দিনে দিনে ক্ষোভ ত্বরান্বিত হয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
এদিকে অনেকেই আশঙ্কা করছিল শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া কেউ কেউ ধারণা করেছিল দখল, চাঁদাবাজি ও প্রতিশোধমূলক হিংস্রতায় মেতে উঠবেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাপক মাত্রায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
তবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। পরবর্তীতে যাদের বিরুদ্ধেই বিশৃঙ্খলা বা দখলদারিত্বে জড়িত থাকার ন্যূনতম সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, তাদের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরই মধ্যে দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের আইনের হাতে সোপর্দ করার আহ্বান জানিয়ে অঘোষিতভাবে সারা দেশে দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন তারেক রহমান।
অন্যদিকে তারেক রহমান প্রতিদিনই বক্তব্যে নতুনত্ব ও একের পর এক বাস্তবমুখী সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে ৩ জেলায় সমাবেশে বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান। তার এসব পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সহায়ক বলে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না মর্মে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যকে অসাধারণ, সময়োপযোগী, পরিপক্ব আখ্যা দিয়ে প্রশংসা করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার বক্তব্য আলোচিত হয়। চায়ের দোকান থেকে গণপরিবহনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষের আলোচনায় তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন সবাই।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, যারাই বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নৈরাজ্য ও অসাংগঠনিক কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূলের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ৫ আগস্টের পর তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একাধিকবার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। তার নির্দেশে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি বাতিল করে কর্মসূচির খরচের টাকা বন্যার্তদের জন্য দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ তিনি ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন এমনকি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছেন। তারেক রহমানের এসব ত্বরিত পদক্ষেপ ও নেতৃত্বগুণ তার স্মার্ট অ্যাকশন এবং তার বাবা শহীদ জিয়াউর রহমানেরই প্রতিচ্ছবি।
তারেক রহমানের যত স্মার্ট অ্যাকশন
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই তাৎক্ষণিক বিজয় বার্তায় তারেক রহমান দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, ‘বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে হাজারো মানুষকে গুম, খুন ও অপহরণ করেছেন। হামলা চালিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে ঘরবাড়ি ছাড়া করেছেন। শেখ হাসিনার অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। এ কারণেই গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালানোর পর নির্যাতিত-নিপীড়িতদের কারও কারও আচরণে হয়তো ক্ষোভের মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আমি খবর পেয়েছি, দেশের কোথাও কোথাও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আমার বক্তব্য স্পষ্ট, কাউকে সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী, কেউ সংখ্যালঘু নয়। আমাদের সবার একটাই পরিচয়, আমরা বাংলাদেশি। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবে কারও প্রতি কোনো ক্ষোভ থাকলে প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ নিন। কিন্তু আপনারা কেউ নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না। অনুগ্রহ করে কেউ প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না।’
এরপর গত ৭ আগস্ট ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে ভার্চুয়াল বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার রক্তঝরা বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’
দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের সম্পদ ও সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার জন্য নেতাকর্মীসহ সবাইকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান তিনি।
দেশের জাতীয় একটি দৈনিকের বরাতে জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর টানা চার রাত ট্রাক দিয়ে বালু এনে পুকুরটি ভরাট করা অভিযোগে ১১ আগস্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) বিলকিস জাহান শিরিনের পদ স্থগিত করা হয়। তবে বিলকিস জাহান সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গত ২১ আগস্ট আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হলে ফরিদপুর বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের পদ স্থগিত করা হয়। বগুড়াসহ কয়েকটি জেলায় যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। কয়েকটি জেলায় নতুনভাবে কমিটি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করেন তারেক রহমান। গত ২৯ আগস্ট রংপুর বিভাগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু হয়। সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিভাগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আবারও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের পরিকল্পনার কথা পুনরায় জানান।
গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি বাতিল করে বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জন্য যেসব টাকা খরচ হতো, সেই টাকা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লার বন্যাদুর্গতদের জন্য বরাদ্দ দেয় দলটি। এর পরই কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ত্রাণ কমিটি গঠন ও ত্রাণ সংগ্রহ কমিটি গঠন করা হয়। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় কয়েক কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছেন।
এ ছাড়া দখল-চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন বাচ্চুকে দল থেকে বহিষ্কার করাসহ ত্রাণ ফান্ডে দেওয়া ১০ লাখ টাকা ফেরত দেয় বিএনপি। পরে তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে মামলাও করা হয়। অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় ঢাকার কলাবাগান থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদককে বহিষ্কার ও তার বিরুদ্ধে দলীয় মামলা করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন স্থানে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বিএনপি।
গত ৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কলারোয়া, ১১ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা ও পৌর বিএনপির সমাবেশ এবং গত মঙ্গলবার ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় সমাবেশে বক্তব্য দেন তারেক রহমান। তিনি সেদিন জোর দিয়ে বলেছেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে, লাখো কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সবার কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত না-ও হতে পারে। কিন্তু এই সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সবার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে। সুতরাং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।’
এ ছাড়া এই সময়ে তারেক রহমানের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় করা, চাঁদাবাজি ও অপকর্মে জড়িত থাকায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীকে শোকজ-বহিষ্কার ও মামলা দায়ের এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং অসংখ্য আহতকে চিকিৎসাসেবা প্রদান।
জানা গেছে, তারেক রহমানের নির্দেশনায় বিএনপির পেশাজীবী সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ) ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ সেল এবং দলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামের মাধ্যমে সহস্রাধিক মানুষকে সহযোগিতা করা হয়েছে।
এই সপ্তাহে ৩ জেলায় সমাবেশ
এদিকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সমাবেশের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারকে সহায়তা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন তারেক রহমান। তারই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল সিরাজগঞ্জে, ২৩ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির উদ্যোগে সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান।
এদিকে বিএনপির উচ্ছপর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করছেন মাস খানেক ধরে তারেক রহমানের প্রতিটি অ্যাকশন স্মার্ট ও সময়োপযোগী। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তারেক রহমানের চিন্তা, চেতনা বা ভাবনার ধারে কাছেও কেউ নেই। তিনি যে ইতিবাচক ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতির যাত্রা শুরু করেছেন, তার সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি জনগণ পাবে বলে আশাবাদী নেতাকর্মীরা।
তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন