দিনাজপুরের বীরগঞ্জে বেড়েই চলছে ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেকোনো সংকট মোকাবিলায় অন্যতম উপায় হচ্ছে বৃক্ষরোপন। পরিবেশ এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গাছের কোন বিকল্প নাই। তাই বলে সবগাছই যে উপকারি অথবা পরিবেশ বান্ধব তা কিন্তু নয়, হতে পারে ক্ষতিরও কারন।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জে দামে সহজলভ্য ও ক্ষতিকর দিক সমূহের সচেতনতার অভাবে চাহিদার শিষ্যে রয়েছে ইউক্যালিপটাস গাছ। ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস চারা রোপণ। ইউক্যালিপটাস গাছ পরিবেশের জন্য কতটা ভয়ংকর ও ক্ষতিকর এই অ লের মানুষের এখনো অনেকেরই অজানা।

ভুক্তভোগী উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড খালপাড়া গ্রামের উত্তম কূমার (৩০) জানান. ইউক্যালিপটাস শোষন জাতীয় গাছ, আমি নিজেই প্রমানিত এর বিষাক্ত পাতা ঝরে পড়ে মাটি ও পানি পর্যন্ত কালো হয়ে যায় ,যার ফলে জমিতে ফলন হতে চায়না বিশেষ করে এই গাছের আশেপাশে যদি ফসল থাকে উৎপাদন একেবারেই কমে যায়। জমির ধারে ৭/৮ টি গাছ লাগিয়েছিলাম যখন দেখতেছি ক্ষতি হচেছ পরবর্তীতে গাছ কেটে ফেলেছি।

একই ইউনিয়নের কৃষক তমিজ উদ্দিন(৫৫) জানান, আমিও ক্ষতির স্বীকার। আমার ১ একর কৃষি জমির মধ্যে অন্যজনের ২ শতক জমির উপর ২০/২৫ টি ইউক্যালিপটাস গাছ আছে তার সংলগ্ন জমিতে বিষাক্ত পাতা ঝরে পড়ে, যার ফলে ৫ কাঠা জমিতে ধান হয় ১/২ থেকে ১ মন।

যেখানে ৫ কাঠা জমিতে ধান হওয়ার কথা ছিল ৭ থেকে ৯ মন পর্যন্ত। এই গাছের বিষাক্ততায় এর আশেপাশের আবাদি খড় গুলো গবাদিপশুও খেতে চায়না। শুষ্ক মৌসুমে ভুট্রার ফলনেও ব্যহত করে। তাই বাগানের মালিককে অনেকবার গাছ কাটার জন্য অভিযোগ করি কাটবো বলে এখনো কাটেনি আমি খুব চিন্তিত।

এক ইউনিয়নের কাজল গ্রামের বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম (৩৫) জানান, অন্যান্য গাছের তুলনায় ইউক্যালিপটাস গাছ দ্রুত বড় হয় ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বিক্রি উপযুক্ত হয়। এ কাঠের চাহিদা বেশি, দামও ভালো পাওয়া যায় তাই ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ করেছি।

এই গাছের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তার আগে জানা ছিলনা তবে আবাদি জমির আইলে ইউক্যালিপটাস রোপণ করায় দিন দিন ফসলের উৎপাদন যে কমে যাচ্ছে, সেটি তিনি স্বীকার করেছেন।

পাল্টাপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মোঃ রুস্তম আলী (৫২) জানান, আমি নিজেই ক্ষতির শিকার বিশেষ করে লম্বা হওয়ায় এই গাছের ছায়া যত দূর পর্যন্ত যায় সেখানে ফসলাদি হয়না, এমনকি পুকরে গাছের পাতা পড়লে পুকুরের পানিগুলো খয়রির মতো রং হয়ে বিষাক্ত হয়ে যায় ,এর প্রভাবে মাছগুলো বাড়েনা এবং পানি শোষন করে জমির পুস্টি সবখেয়ে ফেলে।

চৈত্র,ফাল্গুন মাসে যে জায়গায় এই গাছ থাকে মাটি শুকিয়ে ঠনঠন হয়ে যায়। তাই আমি নিজেও সব গাছ কেটে ফেলেছি। তিনি আরও জানান অত্র ইউনিয়নের একটু ফাঁকা জায়গা থাকলেই বিশেষ করে আবাদি জমির ধারে, রাস্তার ধারে , বসতবাড়ির ফাঁকা জায়গায় কম বেশি সবাই আনুমানিক গড়ে ৬০% থেকে ৭০% লোক এই গাছ রোপন করেছে।

উপজেলার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের মাকড়াই গ্রামের ইউক্যালিপটাস চারা উৎপাদন কারী মোঃ হায়দার আলী (২৮) জানান, খরচ কম লাভ বেশী, চাহিদাও বেশী হওয়ায় তিনি এবার দুই বিঘা জমি ৭০ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়েছেন। ছয়মাস পরে তার উৎপাদিত ৩৫ হাজার গাছের চারা বিক্রির জন্য উপযুক্ত হবে।

যার প্রতিপিস পাইকারি বিক্রি মুল্য ১০ থেকে ১২ টাকা তিনি আশা করেছেন, সবচারা যার বাজার মুল্য আনুমানিক ৩ লক্ষ্য ৫০ হাজার টাকা। তার মধ্যে খরচ হয়েছে ১ লাখের মতো। সবখরচ বাদে ৬মাসে তার ১ লাখের মতো লাভ হবে।

তিনি আরও জানান অত্র এলাকায় পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ড, জগদলসহ তার আশে পাশের এলাকায় আনুমানিক ২৫ জন কৃষক ৩০ বিঘার মতো জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছ নার্সারি আকারে ও কৃষি জমিতে চারা উৎপাদন করেছেন। তারা পাইকারি দরে এই চারা গাছগুলো বিক্রি করেন। এই গাছের ক্ষতিকর প্রভাব সর্ম্পকে জানতে চাইলে জানান, মানুষের কাছে শুনেছি এই গাছ ক্ষতিকর কিন্তু এ বিষয়ে পরামর্শ দিতে এখন পর্যন্ত কেউ আসে নাই।

অবাক করার বিষয় হচ্ছে- গাছটি কেটে ফেললেও মাটির উর্বরা শক্তি ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে যার ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। এত কিছু সমস্যার পরও এ কেমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত? এভাবে চলতে থাকলে এই গাছের ক্ষতিকর প্রভাবে উত্তরা লের প্রকৃতির ভারসাম্য হুমকির মুখে পতিত হতে পারে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, উক্যালিপটাস গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে মাটিকে দ্রুত শুষ্ক করে এবং এই গাছের ঝরা পাতায় টক্সিক পদার্থ থাকে যা কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ইউক্যালিপটাস গাছ অক্সিজেন শুষে নেয়াসহ অন্যান্য গাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যাঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে।

এ বিষয়ে, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ এ এম এম গোলাম আদম কালের কন্ঠকে জানান, ইউক্যালিপটাস গাছ অধিক পরিমাণ পানি শোষণ করে। আশপাশের জমির পানি শুষে নেয় এবং কৃষিজমির গুণাগুণ ও উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। এই গাছ তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং এর পাতায় টক্সিন পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।

সৌন্দর্যবর্ধন এবং দ্রুত কাঠ পাওয়ার আশায় এই গাছ আমাদের দেশে একসময় প্রচুর লাগানো হত তবে এখন অনেকটাই কমেছে। এই গাছে দাহ্য পদার্থের পরিমাণও বেশি তাই এর আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়াতে একে অগ্নি সৃষ্টিকারী হিসেবে ধরা হয়।

আমাদের দেশে সরকারি এবং সামাজিকভাবে এই গাছ লাগানো শুরু হলেও জীববৈচিত্র রক্ষা ও পরিবেশের ভারসাম্যের স্বার্থে ২০০৮ সালে সরকার ইউক্যালিপটাস গাছের চারা উৎপাদন এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করে। পরিবেশ, প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্রের ভারসাম্য রক্ষায় দেশীয় গাছের কোন বিকল্প নেই।

oppo_0