দীর্ঘ ১৫ বছরেও হয়নি মডেল তিন্নি হত্যার বিচার
একটি বেওয়ারিশ লাশ। হত্যাকাণ্ডের শিকার এক নারী। অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই দাফন। সংবাদপত্রের একটি ছোট্ট খবরে মাটিচাপা থাকল না গুমের চেষ্টা। এরপর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে রাখা লাশের ছবি দেখে শনাক্ত হলো পরিচয়। লাশটি বাংলাদেশের জনপ্রিয় মডেল অভিনেত্রী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির।
আজ থেকে ১৫ বছর আগের ওই হত্যাকাণ্ড সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জনমনে জন্ম দিয়েছিল নানা প্রশ্ন ও কৌতূহলের। তদন্তের পর তদন্তে বেরিয়ে আসে নাটকীয়তায় ঘেরা নানা রহস্য। রহস্যের উন্মোচনেও যেন অপেক্ষা করছিল আরো বড় চমক। হত্যাকাণ্ডে যেনতেন কেউ নয়, সাবেক ছাত্রনেতা তৎকালীন এমপি মো. গোলাম ফারুক অভির সম্পৃক্ততা উঠে আসে। শুধু হত্যা নয়, রাতের আঁধারে বুড়িগঙ্গায় লাশের সলিল সমাধির চেষ্টাও করা হয়।
২০০২ সালের ১০ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডটি একটা বড় সময় ধরে দেশে আলোচনার শীর্ষে ছিল। ঘটনাটির খুঁটিনাটিও ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। লাপাত্তা অভি কিংবা মামলাটি এখনো বারবার আলোচনায় উঠে আসছে। কারণ চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও সম্পন্ন হয়নি।
হাইকোর্টের একটি রিটের কারণে প্রায় সাত বছর ধরে ঝুলে আছে মডেল তিন্নি হত্যার বিচার। এই হত্যা মামলার বিচারকাজ চলছিল ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে তিন্নির বাবাসহ তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় মাত্র। এরপর ২০১০ সালে হাইকোর্টে আসামিপক্ষের এক আইনজীবীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিচার।
এরপর কেটে গেছে প্রায় অর্ধযুগের বেশি। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ঢাকা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সপ্তম আদালতে মামলাটি পড়ে আছে বছরের পর বছর।
তিন্নি হত্যা যেভাবে
আদালত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর আগে খুন হন তিন্নি। ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে। এর আগে ৬ নভেম্বর তিন্নিকে তার স্বামী সাক্কাত হোসেন পিয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেন অভি। তিন্নিও তাকে তালাক দেন। ওই দিনই পিয়ালকে তার দেড় বছর বয়সী কন্যাসন্তানসহ রাজধানীর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর বিয়ে করার জন্য অভিকে চাপ দিতে থাকেন তিন্নি। একপর্যায়ে তিন্নি বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেন।
১০ নভেম্বর রাতে খুন হন তিন্নি। মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর গুমের উদ্দেশ্যে ওই রাতে বুড়িগঙ্গার ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেয়া হয় লাশ। কিন্তু পানিতে নয়, লাশটি পড়ে পিলারের উচুঁ অংশে। পরদিন সকালে লাশ ঘিরে জমে উৎসুক জনতার ভিড়।
কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত করে। মর্গে চার দিন রাখার পর ১৫ নভেম্বর অজ্ঞাত হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তিন্নিকে।
এদিকে তিন্নি চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হারানো ডায়েরি করেন। লাশ উদ্ধারের দিন একই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. শফি উদ্দিন। অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের আসামি করা হয় মামলায়।
পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছোট্ট সংবাদের সূত্র ধরে তিন্নির স্বজনরা আঞ্জুমানে মুফিদুলে যান। ছবি দেখে চিনতে পারেন সেটা তাদের প্রিয় তিন্নির লাশ। এরপর ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
সন্ত্রাসী ইমনের স্বীকারোক্তিতে অভির নাম
মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন একই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কাইয়ুম আলী সরদার। পরে মামলাটিতে অভির নাম উঠে এলে তা নিয়ে পড়ে যায় হইচই। চাঞ্চল্যকর বিবেচনায় মামলাটির ভার পড়ে সিআইডির ওপর।
প্রথম দিকে দুই সিআইডি পরিদর্শক মো. ফজলুর রহমান ও সুজাউল হক তদন্ত করেন। এরপর যথাক্রমে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা, মো. আরমান আলী, কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ মামলাটি তদন্ত করেন। অবশেষে ঘটনার ছয় বছরের মাথায় মামলার সপ্তম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মো. মোজাম্মেল হক ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলাটির তদন্ত শেষ করেন।
তিন্নি হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিন্নির স্বামী পিয়াল, এবাদুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী, গাজী শফিউল্লাহ ওরফে তপন গাজী, মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েল এবং সোমনাথ সাহা বাপ্পীসহ কয়েকজন। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। মূলত কারাগারে বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের স্বীকারোক্তিতে ফাঁস হয় তিন্নি হত্যার আসল রহস্য। বেরিয়ে আসে অভির নাম। একমাত্র অভিকেই দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়।
২০০২ সালে অভি পালিয়ে প্রথমে ভারত চলে যান। সেখান থেকে পালিয়ে কানাডায়।
আট বছর পর বিচার শুরু
বিচারের জন্য মামলাটি ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তা ওই বছরের ১৬ মার্চ ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সপ্তম আদালতে বিচারের জন্য যায়। একাধিক শুনানি শেষে ঘটনার ওই বছরের ১৪ এপ্রিল অভির অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। মামলাটির তিন নম্বর সাক্ষী তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম।
২০১১ সালের ১০ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তিন্নির বাবা তার সাক্ষে আদালতকে জানান, অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন না তিন্নি। স্বামী পিয়াল তাকে নানা কৌশলে অভিনয়ে নেন। একদিন পিয়াল তাকে ব্যাংককে শপিংয়ে পাঠায়। সেখানে বাবু নামের এক ভদ্রলোক তাকে সহযোগিতা করবে বলে জানানো হয়। সেই বাবুই ছিল অভি। এরপর অভির সঙ্গে তিন্নির সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হতেই উচ্চ আদালতে অভির পক্ষে করা রিট পিটিশনে (নম্বর-৯৫৩১/২০১০) নিম্ন আদালতে মামলাটির ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।
আসামি অভির রিট
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কানাডার টরেন্টো থেকে অভি পাওয়ার অব অ্যাটর্নির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে এক আইনজীবীর মাধ্যমে মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন, যার রিট পিটিশন নম্বর ৯৫৩১/২০১০। বাংলাদেশে নিম্ন আদালতে চলমান মামলাটিতে অংশ নেয়ার জন্য (ওই দেশে অবস্থিত) বাংলাদেশ দূতাবাসে পাসপোর্ট চেয়ে পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইচ্ছে থাকলেও দেশে আসতে পারছে না বলেও উল্লেখ করেন। তাই তার ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বার্থে পাসপোর্ট পেয়ে দেশে আসা পর্যন্ত মামলাটির কার্যক্রমে স্থাগিতাদেশ চাওয়া হয় অভির পক্ষে।
শুনানি শেষে একই বছরের ১৫ জানুয়ারি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর ২০১১ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। এখন পর্যন্ত রিট আবেদনটি নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে ১৫ বছরেও বিচার হয়নি মডেল তিন্নি হত্যা মামলার।
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খোন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, চাঞ্চল্যকর এই মামলাটির আংশিক সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছিল। ওই সময়ে প্রায় সাত বছর আগে হাইকোর্ট থেকে একটি স্থগিতাদেশ আসে। ফলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়, যা এখনো বজায় আছে।
উচ্চ আদালতের ওই স্থগিতাদেশের ওপর শুনানি শেষে আদেশ এলে তিন্নি হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ আবার শুরু হবে বলে জানান পিপি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন