দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কতোটা সহায়ক ঢাকার রাস্তা?
মোহাম্মদ হাসানের বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন তার চোখ ওঠে। পরিবারে অস্বচ্ছলতার কারণে সে সময় ভাল কোন চিকিৎসক দেখাতে পারেননি।
পরে তার বাবা মা প্রতিবেশীদের কথামতো তাকে স্থানীয় কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। কবিরাজ জানান তার স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ চোখে দিলেই এই রোগ সেরে যাবে।
পরে কবিরাজ কিছু পাতার রস হাসানের চোখের ভেতর দিয়ে দিলে পুরো চোখটাই গলে যায় তার। চীর জীবনের মতো হাসান হারিয়ে ফেলেন তার দৃষ্টিশক্তি।
হাসান বর্তমানে তার উচ্চশিক্ষা শেষে বাংলাদেশ ভিজুয়াল ইমপেয়ারড সোসাইটির আইটি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।
শিক্ষা শেষে স্বনির্ভর হয়ে তিনি অন্ধত্বকে জয় করেছেন ঠিকই, কিন্তু আজও প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় চলাচলে তাকে যে সংগ্রাম করতে হয় তার যেন কোন শেষ নেই।
তারপরও ঢাকার ফুটপাত বেদখল, এবড়োখেবড়ো পথ, যেখানে সেখানে বৈদ্যুতিক খুঁটি, খোলা ম্যানহল এই শহরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পা ফেলাই বিপদজনক করে তুলেছে।
তারমধ্যে সেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যদি নারী হন তাহলে তাকে শিকার হতে হয় আরও নানা হয়রানির।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী উজ্জ্বলা বনিক তার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বিবিসিকে জানান,
“আমরা চোখে দেখতে পারিনা। এজন্য যদি কারো কাছে সাহায্য চাই তাহলে অনেকেই সেটার বাজে সুযোগ নেয়। রিকসায় উঠতে যাব বা বাসে চড়বো, খুব আপত্তিকরভাবে ছোঁয়। একদিন একজনকে বলেছিলাম আমাকে রাস্তা পার হতে যদি সহযোগিতা করতেন। লোকটা আমার হাতে না ধরে দুই বাহুতে ধরলো, মানে তারা আসলে জানে না।”
এ ধরণের আরও নানা হয়রানির কথা জানান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং বাংলাদেশ ভিজুয়াল ইমপেয়ারড পিপলস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, নাজমা আরা বেগম পপি।
“রাস্তায় মানে খুবই বাজে অবস্থা। বাসে চলা তো খুব রিস্কি। এই গায়ে হাত দেবে, নাহলে ব্যাগ থেকে কিছু নিয়ে যাবে। এজন্য আমি সিএনজি না’হলে উবারের গাড়ি ডেকে চড়ি। এতে আমার অনেক খরচ হলেও কিছু করার নেই করতে হয়।”
গত বছরের মার্চে ঢাকার পল্টনের রাস্তায় ম্যানহলের ঢাকনা খোলা থাকায় ভেতরে পড়ে মারা যান একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।
অথচ তাদের অধিকার ও সুরক্ষায় আলাদা আইন আছে। এবং সেখানে এসব সেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
তবে বাস্তবে এসব আইনের কোন প্রয়োগ নেই বলে আক্ষেপ করে মিস পপি।
ঢাকার গণ-পরিবহনগুলো নির্দিষ্ট কোথাও না থামায় অন্যের সাহায্য ছাড়া গণ-পরিবহনে ওঠা দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার।
কোনভাবে উঠতে পারলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য যে সংরক্ষিত আসন আছে সেখানে আর তাদের বসার সুযোগ হয়না বলে তারা অভিযোগ করেন।
এছাড়া প্রতিটি রাস্তায় ব্রেইল গাইড ব্লক সেই-সঙ্গে শব্দ সংকেত না থাকায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে থাকেন তারা। চলাচলের এই সমস্যার কারণে তাদের শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটাও সীমিত হয়ে এসেছে এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য।
এর পেছনে সরকারের সুদৃষ্টি এবং মানুষের সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবকে দুষছেন মিস পপি। বিবিসিকে তিনি বলেন,
“আইন রেখে কি লাভ যদি বাস্তবায়ন না হয়। আমরা চাই সরকার আমাদের এই দিকগুলো দেখুক। আরও প্রচারণা চালাক। যেন সাধারণ মানুষ আমাদের বিষয়টা বুঝতে পারে। আসলে মানুষ এতো ব্যস্ত যে আমাদের দুই মিনিট সময় তারা দিতে পারেন না। অথচ তাদের একট সাহায্য আমাদের অনেকটা নিরাপত্তা দিতে পারে।”
দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের নিরাপদে পথ চলার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন হয় বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুবিধার্থে ঢাকার কয়েকটি এলাকার ফুটপাথের মাঝে হলুদ রংয়ের খাঁজকাটা ব্লক টাইলস বসানো হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের চলাচল বান্ধব একটি শহরের জন্য এটাই কি যথেষ্ট?
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন,”আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করছি সবার জন্য একটি উপযোগী পরিবেশ দিতে। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের এই বিষয়গুলোর সঙ্গে আরও অনেকগুলো সেবা সংস্থা জড়িত। এই সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।”
“এছাড়া সমন্বয় সেবাগুলোতে ওই সংস্থাগুলোর প্রধানদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা। তবে আমরা এই দায় এড়িয়ে যাব না। আমরা চেষ্টা করছি সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে ওঠার। সেইসঙ্গে যদি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কোন দাবি দাওয়া থাকে তাহলে আমরা তাদের পাশে থেকে সব ধরণের সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা করবো।”
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোঃ. হাসান মনে করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ সেই-সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে এ সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলে আজ না হয় কাল এই শহর তাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠবে।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন