দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ
দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক, অর্থাৎ ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০। আর ৭ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ হাজারের কিছু বেশি।
মাদকাসক্তের সংখ্যা নির্ধারণে দেশে প্রথমবারের মতো একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এই সমীক্ষা পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, ১৮ বছর বা এর ঊর্ধ্বের বয়সী মানুষের মধ্যে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মাদকাসক্ত। অন্যদিকে, ৭ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে এই হার শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ।
দেশে মাদকাসক্তের এই সংখ্যাকে উদ্বেগজনক বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই সমীক্ষার আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ধারণা করত, দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। সমীক্ষায় তা অর্ধেক বলা হলেও অধিদপ্তর এখন বলছে, এই সংখ্যাও আশঙ্কাজনক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সমীক্ষা চালানো হয়। দেশের সাতটি বিভাগের সাত বছরের ঊর্ধ্বে ১৯ হাজার ৬৬২ জনের ওপর বাংলাদেশে মাদক ব্যবহারের প্রকোপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের ওপর সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. ফারুক আলমের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বছরব্যাপী পরিচালিত এই সমীক্ষার তত্ত্বাবধান করেন।
সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে মাদক ব্যবহারের প্রকোপ ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ভোটার সংখ্যা হিসাবে বর্তমানের বাংলাদেশে এই জনগোষ্ঠী ১০ কোটি ৪১ লাখ। সেই হিসাবে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, ১২ থেকে বছর ১৮ বছরের মধ্যে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ, ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ মাদক ব্যবহারের প্রকোপে রয়েছে।
১৯ হাজার ৬৬২ জনের কাছ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত প্রশ্নমালা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের অ্যালকোহল, স্মোকিং অ্যান্ড সাবসট্যান্স স্ক্রিনিং টেস্ট (এএসএসআইএসটি) করা হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফারুক আলম।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৮ বছরের নিচে যাদের বছর ছিল, তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন ও পরীক্ষা করা হয়েছে। আর ১৮ বছর বা এর ঊর্ধ্বে যাঁদের বয়স, তাঁদের ব্যক্তিসম্মতে তথ্য নেওয়া হয়েছে। সমীক্ষা অংশগ্রহণকারীদের প্রথমে আর্থসামাজিক এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৩৩টি প্রশ্নের মাধ্যমে তথ্য নেওয়া হয়। এরপর এএসএসআইএসটির মধ্যে কোন কোন মাদক কত দিন ধরে সেবন করা হচ্ছে, সেই তথ্য নেওয়া হয়। সব শেষে মানসিক রোগের উপস্থিতি আছে কি না, এর ওপর ডিএমএস ম্যাথডে ২৪টি সেলফ রিপোর্টিং প্রশ্ন করে তা নির্ণয় করা হয়েছে।
সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, বিভাগ অনুযায়ী মাদক ব্যবহারকারী সবচেয়ে বেশি রয়েছে ঢাকা বিভাগে ৩৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া রংপুর বিভাগে ১৩ দশমিক ৯০, রাজশাহী বিভাগে ৭ দশমিক ১০, সিলেট বিভাগে ৬ দশমিক ৯০, খুলনা বিভাগে ৬ দশমিক ২০ এবং সবচেয়ে কম ছিল বরিশাল বিভাগে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, মাদকের প্রকার অনুসারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গাঁজা ৮২ দশমিক ৯০ শতাংশ, অ্যালকোহল ২৭ দশমিক ৫০, ইয়াবা ১৫ দশমিক ২০, অপিয়ড ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের ওষুধ ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
পুরুষের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারী ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারীদের মাঝে দশমিক ৬ শতাংশ।
পেশা অনুসারে মাদক ব্যবহারকারীর হার শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি—এটি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে বেকার জনগোষ্ঠী, যা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ৪ দশমিক ৩ শতাংশ, কৃষক ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চাকরিজীবীদের মধ্যে মাদক সেবন করেন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে বেশি আয়ের মানুষের মধ্যে মাদক সেবনকারী বেশি। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭ হাজার ৫০০ টাকার নিচে মাসিক খরচকারীদের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারী ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ৭ হাজার ৫০১ টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক খরচকারীদের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারী ২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ১৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে মাসিক খরচকারীদের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারী ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৬০ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ২৫ শতাংশ অ্যালকোহল গ্রহণ করে থাকে।
ধূমপান, গুল, অন্যান্য উপায়ে তামাকপাতা গ্রহণকারী সাত বছরের ঊর্ধ্বে মোট জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে দেশে মানসিক রোগের প্রকোপ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৮ বছরের নিচে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
মাদক সেবনকারীদের ওপর সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ থাকে। এর মধ্যে মারাত্মক অবসাদে আক্রান্ত হয় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, রোগ নিয়ে চিন্তায় থাকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, সব সময় চিন্তাগ্রস্ত থাকে ২ শতাংশ, সিজোফ্রেনিয়ায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ আক্রান্ত থাকে।
মাদক সেবনের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া, রাতের বেলা বিছানায় প্রস্রাব করে দেওয়ার মতো বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ থাকে। কোয়ালিটেটিভ রিসার্চের ফলাফলে মাদকাসক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে যথাক্রমে কৌতূহল, অসৎ সঙ্গ, মাদকের সহজলভ্যতা, অভিভাবকদের নজরদারির অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ সন্তান প্রতিপালনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণা থেকে প্রদত্ত তথ্য দেশে মাদকাসক্তি ও মানসিক রোগ চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যবহৃত হবে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মাদক সেবনকারী সংখ্যা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামালউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে সমীক্ষাটি চালানোর জন্য সাধুবাদ জানাব। এর আগে মাদক সেবনকারীর সংখ্যা কোনো সমীক্ষায় পাওয়া যায়নি। তারাই প্রথমবারের মতো এ ধরনের সমীক্ষা চালিয়েছে। যদিও কেউ কেউ বলতেন, দেশে মাদক সেবনকারী রয়েছে প্রায় ৭০ লাখ। এখন ৩৬ লাখ হলেও এটি আশঙ্কার বিষয়। আমরাও (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর) মাদক সেবনকারী বা গ্রহণকারীদের সংখ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ের সমীক্ষা চালাব। পরিসংখ্যান ব্যুরোর কারিগরি সহযোগিতায় চলতি বছর থেকে এর কার্যক্রম শুরু হবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন