নড়াইলে ৭ মাসে বেপরোয়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত ২২
মোটরসাইকেল পেয়েই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে ঝরে পড়ছে তরতাজা প্রাণ। গত সাত মাসে নড়াইল জেলায় অন্তত ২২ জন হতাহত হয়েছেন। কিশোরদের আবদার মেটাতে অনেক বাবা-মা মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছেন। আবার অনেক কিশোর আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে নিয়ে ঘুরতে বের হচ্ছেন। যার ফলে ব্যাপক আকারে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ জুন কিশোর রিয়াজুল ইসলাম (১৪) বাবা খাজা মিয়াকে মোটরসাইকেলে পেছনে বসিয়ে লোহাগড়া উপজেলার ঘাঘা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে লোহাগড়া শহরে আসছিল। পথিমধ্যে ঢাকা-নড়াইল-বেনাপোল মহাসড়কের লোহাগড়া ব্রিজের পূর্ব পাশে সিঅ্যান্ডবি মোড় এলাকায় পৌঁছালে ঢাকা থেকে যশোরগামী একটি যাত্রীবাহী বাস মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। এতে বাবা-সন্তান দুজনই রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হন। বর্তমানে তারা ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
লোহাগড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাঞ্চন কুমার রায় জানান, অপ্রাপ্তবয়স্ক রিয়াজের ড্রাইভিং লাইসেন্স এর প্রশ্নই ওঠে না এমনকি মাথায় হেলমেটও ছিল না।
গত ১৪ জুন বেপরোয়া গতি কেড়ে নেয় লোহাগড়ার কাশিপুর ইউনিয়নের ঈশানগাতি গ্রামের ওহিদ শেখের ছেলে নাঈম শেখের (১৭) প্রাণ। তিনি ঢাকা-নড়াইল-বেনাপোল মহাসড়কে সদরের হাওয়াইখালী সেতু এলাকায় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি পিকআপে ধাক্কা দেন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
১২ জুন একই সড়কে সদরের তুলারামপুর এলাকায় মোটরসাইকেল-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে প্রাণ যায় তুলারামপুর গ্রামের রিপন খানের একমাত্র ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র রিয়ান হাসান মাফুনের (১৪)। এ সময় গুরুতর আহত হন তার বন্ধু মোটরসাইকেল আরোহী একই গ্রামের খায়রুজ্জামান (১৫)।
শুক্রবার (২৮ জুন) নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ এলাকায় মোটরসাইকেলের সঙ্গে ইজিবাইকের সংঘর্ষে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অমি ইসলাম গুরুতর আহত হন। এভাবে মাঝে মধ্যেই নড়াইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। মোটরসাইকেলের গতি কেড়ে নিচ্ছে এসব তাজা প্রাণ। এদের অধিকাংশই কিশোর-যুবক। গত সাত মাসে নড়াইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে কমপক্ষে ১০ জন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্র মাফুনের বাবা সদরের তুলারামপুর গ্রামের রিপন খান বলেন, গাড়িটি ছিল আমার ভাইয়ের। একমাত্র সন্তান মাফুন আমার জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে এ দুর্ঘটনার শিকার হয়। ও যদি মোটরসাইকেল চালাতে না পারত তাহলে এ অবস্থা হতো না। এ কথা বলতে বলতে বিলাপ করতে থাকেন তিনি।
গত ৭ জুন সদরের তুলারামপুর-শেখাটি সড়কের আফরা এলাকায় নসিমন-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে আফরা গ্রামের ফসিয়ার মীরের ছেলে জিয়া মীর (৩০) নিহত হন।
লোহাগড়ার আমাদা গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক আবু দাউদ চুন্নু ১১ মে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি বাইসাইকেল চালিয়ে লক্ষীপাশা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের কাছে এলে বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসা স্থানীয় যুবক মুছা বিশ্বাস তাকে ধাক্কা দেয়। এতে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় আহত হন মুছা বিশ্বাস।
মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি কেড়ে নেয় নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র শহরের রঘুনাথপুর এলাকার বাবলু সমাদ্দারের ছেলে মামুন সমাদ্দারের প্রাণ। এ সময় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় কাজেম আলী (৩৫) নামে এক শ্রমিক গুরুতর আহত হন। ১১ মে নড়াইল-ফুলতলা-খুলনা সড়কে সদরের কাড়ারবিল এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
গত ১১ এপ্রিল নড়াইল-ঢাকা মহাসড়কে সদরের ডৌয়তলা এলাকায় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সুপারি গাছে ধাক্কা দিলে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার কুমোরপট্টি গ্রামের আসাদ মাতুব্বরের ছেলে আলসাফ মাতুব্বর (২০) ও পথচারী লোহাগড়ার নওয়াপাড়া গ্রামের তরিকুল শেখ (৪৫) মারা যান। এ ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহতের বন্ধু একই এলাকার মোস্তাক সর্দার এবং মুস্তাকিন গুরুতর আহত হন।
১৩ এপ্রিল একই সড়কে মুলদাইড় এলাকার সঞ্জিত ঘোষের ছেলে মোটরসাইকেলের চালক তপু ঘোষ (২৫) দুটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান। এ ঘটনায় একই এলাকার যুবক সঞ্জয় ঘোষ, তানভির জিহাদ এবং যশোরের শংকরপাশা গ্রামের আয়াদ গুরুতর আহত হন।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর নড়াইল-মাগুরা সড়কের সদরের কাগজীপাড়ায় পণ্যবাহী ট্রলি ও মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। নিহতরা হলেন—লোহাগড়ার মিঠাপুর গ্রামের নবীর মোল্যার ছেলে মোটরসাইকেল চালক বাদশা মোল্যা (৪৫) ও আরোহী একই গ্রামের ছবুর শেখের ছেলে মাদরাসাছাত্র আলীম পরীক্ষার্থী কাফিল শেখ (২২)। গত এক বছরে তার জানা মতে নড়াইলে কমপক্ষে ২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৪-১৫ জন মারা গিয়েছে যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ কিশোর।
নড়াইল-ঢাকা মহাসড়কের নড়াইল অংশে সড়কটি দুই লেনের হওয়ায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। সড়কটি চার লেন হলে দুর্ঘটনা কমতো। এছাড়া সারাদেশে নো হেলমেট, নো ফুয়েল চালু হলেও নড়াইলে তা এখনো কার্যকরী হয়নি। সড়ক নিরাপত্তা আইন-২০১৮ বাস্তবায়নে প্রশাসন আরও বেশি আন্তরিক হলে এ দুর্ঘটনা কমবে।
নড়াইল ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টি আই) কাজী হাসানুজ্জামান বলেন, নড়াইলে এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের একটি মোটরসাইকেল নেই। গত এক বছরে যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। কিশোরদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ার জন্য মা-বাবাই দায়ী। গত এক বছরে ১৮৪৩টি মোটরসাইকেল আটক এবং ৬০ লাখ ২ হাজার ৩৭৫ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন