নলী বাড়ৈ বাড়ি স্মৃতিস্তম্ভে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লেখা নিয়ে বিতর্ক কাটেনি

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের নলী খেয়াঘাট সংলগ্ন নব নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লেখা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ৈ বাড়ি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা,অংশগ্রহনকারী আহত এবং অংশগ্রহণকারীদের নাম সংবলিত একটি স্মৃতিফলক স্তম্ভের গাইড ওয়ালের পাশেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।

স্থানীয়দের কেউ বলছেন শুধু শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লেখা থাকবে আবার কেউ বলছেন নলী বাড়ৈ বাড়ি যুদ্ধে আহত এবং অংশগ্রহণকারীদের নামও থাকবে।আর এ নিয়ে স্তম্ভটি নির্মানের এক বছর পরেও কাটেনি বিতর্ক।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দোসর পাকিস্তানপন্থী লুটেরা বাহিনী ও সহযোগী বর্বর বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমন প্রতিহত করতে সম্মুখ যুদ্ধ করে নলীবাসী ও নলীতে আশ্রিতজনেরা। অত্যান্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নলীবাসী পরাস্ত হলে পাকিস্তানী মদদপুষ্ট বাহিনী তাঁদের উপর নির্বিচারে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়।লুণ্ঠন করে হিন্দু বাড়ির ধন সম্পদ।

দেশ স্বাধীনতার আহ্বানে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সুন্দরবনঘেষা নদীমাতৃক এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে নলীবাসীই সর্ব প্রথম বাড়ৈ বাড়ির নেতৃত্বে পাকিস্তানি অনুসারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাঁরা ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।এতে যারা শহীদ হন তাদের লাশ নলী খেয়াঘাট থেকে হলতা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নলী বাড়ৈ বাড়ি যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কতজন শহীদ হয়েছে, কাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে আর কাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে না এ নিয়ে স্বীদ্ধান্তহীনতার কারনে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত লাগানো হয় নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংবলিত শিলালিপি।

ইতোমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয়দের একাংশ ১৮ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা,যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত ৪৭ জন এবং অংশগ্রহকারী ৮৫ জনের নাম সংবলিত একটি স্মৃতিফলক তৈরি করেন।কিন্তু এ নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ এবং স্বীদ্বান্তহীনতার কারনে ভেঙে চুরে মাটিতে পড়ে রয়েছে ফলকটি।

স্থানীয় রমেশ চন্দ্র মিস্ত্রী জানান,নলী বাড়ৈ বাড়ি যুদ্ধে নিশি কান্ত বিশ্বাস এবং তাঁর তিন পুত্র সুরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস,জিতেন্দ্রনাথ বিশ্বাস,উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস সহ ১৩ জন শহীদ হন।কিন্তু একটি পক্ষ এখানে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ছাড়াও জীবিত, আহত ও অংশগ্রহনকারীদের নামও শিলালিপিতে লিখে স্মৃতিস্তম্ভটিতে লাগাতে চায়।এ নিয়ে উভয় পক্ষই এখনও টানাপোড়েনের মধ্যে আছে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় ‘দেশটাকে ভালবেসে’ শিরোনামে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের নলী বাড়ৈ বাড়ি যুদ্ধ নিয়ে আমার স্বাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মোঃ সাজ্জাদ হোসেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরেন্দ্র নাথ বিশ্বাসকে এ নিয়ে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায় নি।তবে তিনি বরিশালে চিকিৎসা নিতে গেছেন বলে জানা গেছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. দিলীপ কুমার পাইক জানান,সাবেক গণপরিষদের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ সাওগাতুল আলম সগীরের নির্দেশে জগ্গেশ্বর বাড়ৈ বাদী হয়ে নলী বাড়ৈ বাড়ি যুদ্ধাপরাধীদের আসামী করে ট্রাইবুনালে একটি মামলা দায়ের করেছিল। ওই মামলায় ১২ জনকে শহীদ উল্লেখ করা হয়। মামলার পরে আরও একজন নিহত হয়।এরপর ওই মামলার বাদী ও বাদীর ভাইকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

তিনি আরও বলেন,স্মৃতিস্তম্ভে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নাম টানাতে পারে।তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকেই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা পাওয়া যাবে।

যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক খান মজনু জানান,আমি শীঘ্রই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে একটি তালিকা সংগ্রহ করবো।

নলী বাড়ৈ বাড়ি মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সাধারন সম্পাদক এবং সাফা ডিগ্রি কলেজের অবঃ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিনয় কৃষ্ণ বল জানান,আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চাই। যেহেতু এখানে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে যুদ্ধ হয়েছে সেজন্য নব নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ ,আহত এবং অংশগ্রহনকারীদের নাম সংবলিত স্মৃতিফলক সংযুক্ত করা দরকার বলে আমরা মনে করি।

পিরোজপুর গণপূর্ত বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. সুলতান মাহমুদ শৈকত জানান,স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একটি তালিকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে জমা দিবেন।অফিস থেকে যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে তালিকাটি অগ্রগামী করে হবে।এরপর মন্ত্রনালয় থেকে চুড়ান্ত তালিকা স্মৃতিস্তম্ভে লাগানোর জন্য পাঠানো হবে।

মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বাচ্চু মিয়া আকন জানান,উপজেলা নির্বাহী অফিসে এখনও তালিকা পাঠানো হয়নি।খুব শীগ্রই যাচাই-বাছাই করে নলী বাড়ৈ বাড়ি স্মৃতিস্তম্ভের জন্য একটি তালিকা পাঠানো হবে।