নারী কি আদৌ স্বাধীন হতে পেরেছে?
প্রথমেই বলি, আমি কোন লেখিকা, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গদ্যকার কিংবা কবি না। পেশায় আমি একজন মডেল, অভিনেত্রী। ছোটবেলায় প্রচুর বই পড়তাম। বিশেষ করে সায়েন্স ফিকশন আর নারীবাদী বইগুলোর ভীষণ ছড়াছড়ি ছিল পড়ার টেবিলে..। পড়েছি নির্মলেন্দু গুণ, শীর্ষেন্দু মুখ্যেপাধ্যায়, সুনীল গঙোপাধ্যায় এর মতো বড় বড় লেখক, সাহিত্যিকের বই।
যাই হোক, আজ নারী দিবস উপলক্ষে আমি একান্তই ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লিখব। আমার চোখে দেখা নারী স্বাধীনতা নিয়ে লিখব। আমার ছোট বেলায় দেখা নারী স্বাধীনতা আর এখনকার দেখা নারী স্বাধীনতা…।
নারী কি আদৌ স্বাধীন হতে পেরেছে? স্বাধীন হলেও কতটুকু স্বাধীন হতে পেরেছে? সে কি মুক্ত চিন্তা করতে পারছে? পারলেও তার প্রয়োগ কতটুকু করতে পারছে? তার কি বাক স্বাধীনতা আছে? থাকলেও কতটুকু?
ছোট বেলায় আর দশটা সাধারণ মেয়েদের মতো মাথার দু’পাশে দু’টো বেণি ঝুলিয়ে আমিও স্কুলে যেতাম, খেলতাম, গল্পের বই পড়তাম, পাশাপাশি ড্রয়িং ক্লাসে যেতাম। নাচ শিখতাম আর আম্মুকে ভীষণ ভীষণ জ্বালাতাম।
কিন্তু ছোটবেলায় যে জিনিসটি আমাকে নাড়া দিয়েছিল তা হল সেক্সিজম। হুম সেক্সিজম.. লিঙ্গ বৈষম্যতা…
আমি কেন জানি কিছুতেই মানতে পারতাম না নারীদের প্রতি বৈষ্যমতা..। কেন জানি মনে হয় এই না মানতে পারাই আমাকে আজকের সানাই বানিয়েছে…।
সেই ছোটবেলা থেকেই আমার আশেপাশের মানুষ কিংবা আমার আত্মীয় স্বজনেরা যেমন- আমার খালা, চাচী, ফুফুদের দেখে আমি ক্ষণে ক্ষণেই চিন্তার গভীরে ডুব দিতাম। ওদের জীবন যাপন, ওদের চিন্তাভাবনা কখনোই মিলত না আমার সাথে। জানি না কেন এতো অল্প বয়সেই আমি এতো ভাবুক হয়ে উঠছিলাম!
হয়ত আমাকে দেওয়া অবাধ স্বাধীনতাই আমাকে ভাবিয়েছে প্রতিনিয়ত। অবাধ স্বাধীনতা বলতে মনে পড়ল ছোটবেলাকার একটা স্মৃতি…। খুব সম্ভবত শীতকাল হবে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। অবসর সময়ে টিভি দেখে, গল্পের বই পড়েই সময় কাটাই। সে রকমই এক শীতের দুপুরে আমি টিভি দেখছি আর মা স্বভাবতই রান্না করছেন। এমন সময়ে পাশের বাড়ির এক আন্টি বাসায় আসলো। মা তাকে বসতে দিলেন। সে মাকে একা রান্না ঘরে দেখলো অমনি চিল্লানো শুরু করল, ‘কি গো সানাই এর মা, রান্নাবান্না কিছু শিখাইবানা মাইয়ারে, তুমি কি বিয়া সাদি দিতানা?’
মা কিছুটা রেগে গিয়েই বললেন, ‘আমার মেয়ে কেনো রান্না করবে? ও পড়াশোনা করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক’।
মা তুমি জানো না, তোমার এই একটা কথা আমাকে কী শক্তি দিয়েছে, কী সাহস জুগিয়েছে সেই ছোট বয়সেই…। কী অনুপ্রাণিত হয়েছি আমি সেই ছোট বয়সেই..। আমার মনে হয়েছে, আমি চাইলেই অসাধারণ হতে পারব। আমি চাইলেই আমার জীবনটাকে সাজাতে পারব ভিন্নভাবে…।
আমি এখনো ছোট বেলার সেই কথা চিন্তা করলে অবাক হয়ে যাই। এই ছোট্ট একটা কথা আমার মনে কী দাগ কেটেছিল বোঝাতে পারব না মা..। এই ছোট ছোট কথাগুলোর এফেক্ট-ই কিনা জানি না। আমার চারপাশের মানুষগুলোর চিরায়ত জীবনযাপন আমার ভালো লাগত না। মেয়ে মানুষ সম্পর্কে তাদের যে ধারণা তা আমাকে ভাবাত প্রতিনিয়ত। আমি ভাবতাম, কেন মেয়ে মানুষ সম্পর্কে তাদের এতো বিরূপ মনোভাব? কেন মেয়ে মানুষ শুধুই রান্না শিখবে আর স্বামীর সাথে সহবাস করবে, বাচ্চা লালন পালন করবে আর বাচ্চা জন্ম দিবে? কেন শুধু এগুলাই একটা মেয়ে মানুষের জীবনের লক্ষ্য হবে?
আমি সারাদিন, সারারাত, সারামাস, সারাবছর ভাবতাম আর ভাবতাম…। ভেবে ভেবে একটাই সারমর্মে আসতে পেরেছি যে, সংসার করার জন্য জীবন হতে পারে না। জীবনের জন্য সংসার, জীবনের প্রয়োজনে সংসার, সংসার তো জীবনের একটা পার্ট…। একটা সুন্দর অংশ মাত্র। জীবন তার থেকেও বড়.. অনেক বিস্তৃত..। অনেক…
আজকে যখন ১০ বছর আগের সেই কথাগুলো চিন্তা করি। তখন একটা কথাই মনে হয় কী আমূল পরিবর্তন এই সমাজের! যদি তাই না হবে তাহলে আজকে আমি সানাই কিভাবে এতো কনজারভেটিভ সমাজে থেকেও আমার ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করার কথা চিন্তা করেছিলাম! কিভাবে আমি ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করার মতো এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম! সেকাল আর একাল…।
সমাজের কিছু দিক পরিবর্তন তো হয়েছেই কিন্তু কতটুকু? নারী কি পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছে? সে কি মুক্ত হতে পেরেছে? হলেও কতটুকু? তার পরিমাণ কতটুকু? এক পেয়ালার সমান নাকি এক বালতির সমান! নাকি এক চামচের সমান?
যদি তাই না হবে, তাহলে আমাকে ঘিরে মানুষের এতো সমালোচনা কেন? কেন তারা আমার অস্ত্রোপচার এর বিষয় টিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না! এটা তো আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কেন তারা সমাজের এই পরিবর্তন কে মেনে নিতে পারছে না! যেখানে অগ্রগামী সমাজের নিয়মই হল পরিবর্তন..।
কেন আমার দিকে বারবার আঙুল তুলছে মানুষ! আমার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করছে তারা…।
এতো কিছুর পরেও আমি আশাবাদী, ভীষণ আশাবাদী যে একদিন নারী জিতবে…। কারণ তাকে যে জিততে হবেই… সামনে এগুতে হবেই, সামনের দিনগুলো নারীর জন্য সুন্দর হবে, সাবলীল হবে…।
এই প্রত্যাশায়… আমি
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন