নির্বাচন ঘিরে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা রয়েছে জঙ্গিদের। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সতর্ক করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সময় পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এবং ইউনিটকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিরা আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে জানিয়ে ওই বার্তায় বলা হয়, এবার তাদের টার্গেটে রয়েছে পুলিশ ও তাদের বিভিন্ন স্থাপনা।
দেশের একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরের সত্যতা স্বীকার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিসিটিসি) ইউনিট ও একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, জঙ্গি সংগঠনগুলোর নতুন সদস্য ও তহবিল সংগ্রহ এবং নতুন টার্গেট নির্ধারণের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদের অভিমত, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক কারণেই জঙ্গি তৎপরতা বাড়ে। কারণ এদের দিয়ে রাজনীতি প্রভাবিত করা সম্ভব হয়। তিনি লেন, এখন জঙ্গিরা এমন টার্গেট নির্ধারণ করবে, যাতে নির্বাচন প্রভাবিত হয়।
অন্যদিকে সিসিটিসি’র প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিরা সব সময়ই সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। সে চেষ্টা এখনও চলছে। তবে তারা যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এই অতিরিক্ত কমিশনার আরো বলেন, জঙ্গিদের আগের মতো সাংগঠনিক শক্তি নেই। অভিযানে অনেক নেতা ধরা পড়েছে, অনেকে মারা গেছে। বড়দের অনুপস্থিতিতে ছোটরা নেতৃত্বে চলে এসেছে। তারাই সদস্য ও অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশেই তারা নজরদারি বাড়িয়েছেন। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় জঙ্গি ধরা পড়েছে, যারা জেএমবি (জামায়া’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ), নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের সদস্য। এরই মধ্যে গত ১১ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে মুক্তমনা কবি ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যা এবং ১৪ জুন মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী সুমন জাহিদের দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার হওয়ার পর ফের আলোচনা আসে ইসলামী উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো।
সিসিটিসি’র প্রধান জানান, শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুলিশের ধারণা- আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
তবে সুমন জাহিদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে জানিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, এখনই মন্তব্য করার সুযোগ নেই যে, এটা হত্যা, আত্মহত্যা, না কি অন্য কিছু। এছাড়া জঙ্গিরা তহবিল সংগ্রহে ডাকাতি-ছিনতাই করছে বলেও তথ্য আছে। সম্প্রতি ঢাকা, রাজশাহী ও গাজীপুরে অন্তত ১৫টি ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনায় জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে গোয়েন্দারা দাবি করেছেন।
মেজর জেনারেল (অব.) রশিদ বলেন, মূলত আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতায় ছেদ পড়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব দেশ তাদের সমর্থন দিত, তারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। যে কারণে জঙ্গিরা অর্থ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সঙ্কটে রয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছে। যে কারণে স্থানীয়ভাবেও অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জঙ্গিরা অনেক আগে থেকেই ছিনতাই-ডাকাতি করছে।
রশিদ আরো বলেন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে (২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি) প্রিজনভ্যান থেকে জেএমবির তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনের অর্থও তারা লোকালি সংগ্রহ করেছিল।
উল্লেখ্য, ত্রিশালের সেই অপারেশনে পুলিশ খুন করে পালানো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানিই বর্তমানে ভারতে থেকে পুরনো জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চিঠিতে মিলেছে সহিংসতার আভাস : গত ১৯ মার্চ বগুড়া থেকে জেএমবির রাজশাহী অঞ্চলের নেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে রাকিব, আবু বক্কর ওরফে সীমান্ত ও ইব্রাহিম ওরফে আবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছে পাঁচ পৃষ্ঠার দুটি চিঠি পাওয়া যায়।
পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে ঢাকার একটি দৈনিক লিখেছে, এক জঙ্গি কারাগারে বসে চিঠি দুটি লিখেছেন। যা মূলত সেই সালেহীন অর্থাৎ জেএমবি প্রধানের উদ্দেশ্যে লেখা। চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘অ্যামুনেশন সংগ্রহে তৎপর হওয়া দরকার। সামনে নির্বাচন। বিভিন্ন রকম সহিংসতা হবে। এই সুযোগ কাজে লাগানো দরকার।’
মেজর জেনারেল (অব.) রশিদ বলেন, ‘হোলি আর্টিজানের হামলার (২০১৬ সালের ১ জুলাই) পরও আমরা দেখেছি আমাদের রাজনৈতিক মত দ্বিধাবিভক্ত ছিল। জঙ্গিরা এটাকে আমাদের রাজনীতির দুর্বলতা হিসেবেই দেখে। নির্বাচনের সময় যেহেতু এই দুর্বলতা আরো প্রকট হয়, এই সুযোগটাই তারা নেবে।’ আসলে এ রকম পরিবেশেই জঙ্গিরা বাড়ার সুযোগ পায় বলে দাবি করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে শঙ্কা : গত ১২ জুন কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন নব্য জেএমবির নারী শাখার প্রধান হুমায়রা ওরফে নাবিলা। প্রায় একই সময়ে আরো অন্তত পাঁচজন জামিনে বের হয়ে গেছেন। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে বলা হয়, ‘গত বছরের ২ জুন থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে প্রায় ৩০০ জন জঙ্গি সদস্য জামিনে মুক্তি পেয়েছে। যাদের বেশিরভাগই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার আসামি।’
মেজর জেনারেল (অব.) রশিদ বলেন, জঙ্গি সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করা সময়সাপেক্ষ বলেই তারা জামিনের সুযোগ পায়। এটা একটা বড় সমস্যা। মুক্ত জীবনে তারা আবারো জঙ্গিবাদে যুক্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। তাদের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘অনেকেই কারাবন্দি অবস্থায় অন্য শীর্ষ জঙ্গিদের সংস্পর্শে থেকে নতুন করে জঙ্গিবাদের তালিমও নিয়েছেন।’ তবে হোলি আর্টিজান কাণ্ডের পর জঙ্গি বিরোধী ৩২টি সফল অভিযান এদেশীয় জঙ্গিদের সক্ষমতা ক্ষয় করেছে উল্লেখ করে রশিদ বলেন, জেলের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার থামানোর জন্যও সরকারের কিছু উদ্যোগ থাকা উচিত।
প্রসঙ্গত, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেও এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন