নির্বাচন যত কাছে আসছে, অস্থিরতা ততই বাড়ছে
বাংলাদেশে নির্বাচন যত কাছে আসছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। নির্বাচন ঘিরে কোনো পক্ষই এখন স্বস্তিতে নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বেশির ভাগ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে বাদানুবাদ-দ্বন্দ্ব, কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কোনো কোনো ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের পর বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি ও প্রতিবাদ ওঠা এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে, বিশেষ করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে দেশে-বিদেশে চাপ থাকা আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলেছে। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডও ক্ষমতাসীনদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
রাজনীতি ও ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সংকট অন্য রকম। এই মুহূর্তে দলটি তাদের তৃণমূলে নির্বাচনে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে কোনো বার্তাই পৌঁছাতে পারেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না দলটির নেতারা। কোনো দাবি পূরণ ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে গত দশম সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না—এমন বার্তা দলের তৃণমূলে ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে আছে বিএনপি। তা ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির অংশগ্রহণের পর তাদের পুরোনো জোট ২০-দলীয় জোটে ভাঙন দলটিকে চাপে ফেলেছে। ২০ দলের ঐক্য ধরে রাখতে বিএনপির নেতারা এখন দৌড়ঝাঁপ করছেন।
রাজনীতির এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বসে নেই ছোট দলগুলো। তারা জোট করছে আবার ভাঙছেও। হিসাব কষছে কোন জোটে গেলে লাভ বেশি। ছোট দলগুলোর আচরণ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির কিছুটা ধোঁয়াশা অবস্থান নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে থাকবে, নাকি আলাদা জোট করে ভোটে আসবে, সেটি এখনো দলটি স্পষ্ট করেনি।
অবশ্য ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তি, উত্তেজনা, সংকট থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। এসব বিষয়ে কোনো মীমাংসা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা নিয়ে সবাইকে শেষ দিন পর্যন্ত অস্বস্তিতে থাকতে হবে। তবে রাজনীতির সাম্প্রতিক পরিবেশ ভারী হওয়া ও সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে সন্দেহ, উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের আচরণ। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে ঘিরে কমিশনের কাজে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আবার নির্বাচন কমিশনের কাজ কমিশনারদের অবহিত না করা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে মাহবুব তালুকদারসহ অন্য কমিশনারদের দূরত্ব তৈরি হয়। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়েও আপত্তি আছে কমিশনারদের। শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার কীভাবে হবে, কতটা হবে—এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেমন পক্ষ-বিপক্ষ আছে, তেমনি তাঁরা ইভিএমে ভোট নেওয়া নিয়ে আছেন অস্বস্তিতে। অস্বস্তির কারণ অল্প সময়ের মধ্যে যাঁরা ইভিএম পরিচালনা করবেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ এবং ভোটারদের ইভিএমে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে অভ্যস্ত করে তোলা।
অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা মনে করছেন তাঁদের মধ্যে যে মতবিরোধ আছে তা নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা আছে। এ থেকেই অস্বস্তি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিগত সময়ে, বিশেষ করে দশম সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ভোট হতে খুব একটা দেখা যায়নি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ভোট নিয়ে ভাবছে, এবার কেমন ভোট হবে। আর ভোটাররা ভাবছেন, তাঁরা তাঁদের ভোট দিতে পারবেন কি না বা তাঁদের ভোটের প্রতিফলন ফলাফলে থাকবে কি না।
এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলকে আশ্বস্ত করতে হবে। যেটা এই কমিশন পারছে না। ফলে সব দিকে, সব অংশীজন বা পক্ষের মধ্যে অস্বস্তি ভর করছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সম্পাদক মনে করেন, ভোটের আগে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা আছে। কোন্দলই মূলত আওয়ামী লীগের বড় সংকট। অবশ্য এ নিয়ে দলীয় সভানেত্রী সতর্ক আছেন। ইতিমধ্যে মাঠপর্যায়ের নেতাদের বিশৃঙ্খলা এড়াতে বলা হয়েছে। তা না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই দুই নেতা বলেন, নির্বাচন কমিশনের দিকে তাঁরা নজর রাখছেন। তবে কমিশনের যে সমস্যা তা সমাধান হয়ে যাবে বলে তাঁদের ধারণা। এতে ভোটে প্রভাব পড়বে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, ভোটের আগে কিছু চাপ সব সময়ই থাকে। বিদেশিরা যেমন সবার অংশগ্রহণে ভোট চায়, আওয়ামী লীগও তেমনটি চায়। আর এবার সব দল ভোটে আসবে বলেই তাঁরা মনে করেন।
বিএনপির সমস্যাটা নিজেদের নিয়ে। মূলত সরকার যদি কোনো দাবিই না মানে, তাহলে এবার ভোটে যেতে বিএনপির যুক্তি কী হবে তা নিয়ে দলটির মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। নেতাদের বিপরীতমুখী অবস্থান দলকে চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। সম্প্রতি গুলশান কার্যালয়ের বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বৈঠক ও ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি শেষ পর্যন্ত ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে যুক্তি হিসেবে খালেদার মুক্তি নিশ্চিত করা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো এবং সর্বোপরি দেশে দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর কথা বলবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, বিএনপির চেয়ে অস্বস্তি বা সংকট সরকারের বেশি। বিএনপি নির্বাচনে যেতেই সবকিছু করছে। তা ছাড়া এবার সরকার একতরফা নির্বাচন করে পার পাবে, সেটা ভাবার কারণ নেই। এটা সরকারও বোঝে। বিএনপির এই নেতা বলেন, তাঁদের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করেছে। বিদেশিরা মনে করছেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। ফলে রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও বিএনপি তা কাটিয়ে উঠবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন