নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে যে তথ্য দিলেন ১২ আসামি
ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার এক মাস আজ। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১২ জন আসামি আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহামেদ ও মো. জাকির হোসাইনের আদালতে আসামিদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
জবানবন্দি দেয়া আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, তার সহযোগী নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল। এরা প্রত্যকেই নুসরাত হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। জবানবন্দিতে আসামিরা যেসব তথ্য দিয়েছেন তা তুলে ধরা হলো-
নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম
১৪ এপ্রিল আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন নুসরাত হত্যা মামলার ২ ও ৩ নম্বর আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম। ওই দিন প্রায় ১০ ঘণ্টা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
পরে রাতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন) তাহেরুল হক চৌহান সাংবাদিকদের জনান, আসামিরা অপরাধ স্বীকার করেছেন। তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। নুর উদ্দিন ও শাহাদত হোসেন শামীম জেলখানা (সিরাজ উদ দৌলা) থেকে হুকুম পেয়েছেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, শামীম ও নুর উদ্দিন ১ ও ৩ এপ্রিল কারাগারে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে দেখা করেন। পরে তার নির্দেশে ৪ এপ্রিল মাদরাসায় পরিকল্পনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে পরিকল্পনা মতে ৬ এপ্রিল নুসরাতকে ডেকে সাইক্লোন শেল্টারের ওপরে তুলে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়।
আবদুর রহিম ওরফে শরীফ
নুসরাত হত্যায় দায় স্বীকার করে ১৭ এপ্রিল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন আবদুর রহিম ওরফে শরীফ। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আদালতে আনা হয় নুসরাত হত্যায় সন্দেহভাজন আবদুর রহিম ওরফে শরীফকে। টানা ৬ ঘণ্টা জবানবন্দি রেকর্ড করে সাড়ে ৯টায় শেষ হয়।
পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল জানান, মাদাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে ও পরামর্শে নুসরাতকে হত্যার জন্য গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানো হয়। এ জন্য ২৮ ও ৩০ মার্চ দুই দফা কারাগারে থাকা মাদরাসার অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেন তারা। ৪ এপ্রিল সকালে ‘সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদের’ সভা করা হয়। রাতে ১২ জনের এক সভায় হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। তার (রহিম) দায়িত্ব পড়ে মাদরাসার ফটকে। সেখানে নুর উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদেরও ছিলেন। মাদরাসার ছাদে বোরকা পরে ছিলেন শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের আহাম্মদ, জাবেদ হোসেন, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা ও মনি।
হাফেজ আবদুল কাদের
নুসরাত হত্যায় দায় স্বীকার ১৮ এপ্রিল একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মামলার অন্যতম আসামি হাফেজ আবদুল কাদের। ওইদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে জবানবন্দি রেকর্ড শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে শেষ হয়। হাফেজ আবদুল কাদের আদালতের কাছে স্বীকার করেছেন তিনি ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ঘটনার দিন তিনি হত্যাকারীদের নিরাপত্তায় মাদরাসার গেট পাহারায় ছিলেন এবং পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম।
পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল জানান, হাফেজ আব্দুল কাদের এ হত্যাকাণ্ডে নিজের সক্রিয় অংশ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন। তার রুমেই নুসরাত হত্যার পরিককল্পনা হয় বলে জবানবন্দিতে তিনি স্বীকার করেছেন।
উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা
নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে ১৯ এপ্রিল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ভাগনি (শ্যালিকার মেয়ে) উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা।
পিআইবির চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল বলেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে যে দুজন নারী সদস্য জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি ওরপে শম্পা একজন। তিনি জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার বলেন, নুসরাতকে তিনি নিচ থেকে ডেকে নেন এবং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পানা ও হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।
কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন
নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ২০ এপ্রিল আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন। সিনিয়ন জুডিশিয়াল ম্যজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহমদের আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়ার পর ওই দিন রাত ১০টার দিকে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগে বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল জানিয়েছেন, আদালতে কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।
জবানবন্দিতে তারা জানান, নুসরাতকে ছাদে নিয়ে যাওয়ার পর শাহাদাত হোসেন শামীম ও নুর উদ্দিন তাকে মেঝেতে ফেলে দেন। এ সময় মনি তার বুক চেপে ধরেন ও জাবেদ হোসেন তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন।
জোবায়ের আহমেদ
নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করে ২১ এপ্রিল আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন জোবায়ের আহামেদ। ফেনীর সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালত তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
পরে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল বলেন, জোবায়ের আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে তিনি ঘটনার দিন কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন এবং ম্যাচের (দিয়াশলাই) কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা
নুসরাত হত্যার নির্দেশ দেন সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। ২৮ এপ্রিল রোববার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালেতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন তিনি। পরে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল বলেন, নুসতার হত্যার মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন জেলহাজত থেকে তিনি নুসরাতকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। জেলে থাকা অবস্থায় নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়ার জন্য বলেন অধ্যক্ষ সিরাজ। কাজ না হলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে নির্দেশ দেন তিনি।
ইফতেখার হোসেন রানা ও এমরান হোসেন মামুন
নুসরাত হত্যার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও কিলিং মিশনে অংশ নেয়াদের নিরাপদে বের হয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন ইফতেখার হোসের রানা ও এমরান হোসেন মামুন। ৬ মে নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তারা।
পরে পিপিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল জানান, ইফতেখার হোসেন রানা ও এমরান হোসেন মামুন নুসরাত হত্যার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন বলে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন- নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনায় ৪ এপ্রিল হাফেজ আবদুল কাদেরের কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় তারা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার দিন তারা মাদরাসা ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও কিলিং মিশনে অংশ নেয়াদের নিরাপদে বের হয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন।
মহিউদ্দিন শাকিল
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় মাদসারার সাইক্লোন শেল্টারের সিঁড়ি পাহারার দায়িত্বে ছিলেন নুসরাতের সহপাঠী মহিউদ্দিন শাকিল। ৭ মে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন তিনি। পরে রাত ১১টার দিকে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল বলেন, গত ৬ এপ্রিল মাদরাসার সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলার ছাদে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়ার সময় মহিউদ্দিন শাকিল সাইক্লোন শেল্টারের গেটে পাহারায় ছিলেন। এ সময় সেখানে অপর আলিম পরীক্ষার্থী মো. শামীমও তার সঙ্গে ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।-জাগো নিউজের সৌজন্যে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন