পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যায় ইসরাইল জড়িত: ইরান
ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছেন ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশটির পরমাণু কার্যক্রমকে দমিয়ে রাখা যাবে না বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।
রুহানি বলেন, মোহসেন ফাখরিজাদের হত্যা দেখিয়ে দিয়েছে ইরানের শত্রুরা কতটা বিদ্ধেষপরায়ন এবং হতাশায় নিমজ্জিত।
ইসরাইল এখনও পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি। এর আগে ফাখরিজাদেকে ইরানের গোপন পরমাণু কর্মসূচির নেপথ্য নায়ক বলে অভিযুক্ত করে তেল আবিব।
এর আগে ইরানের সামরিক বাহিনী এবং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এরপরই রুহানি ইসরাইলকে দায়ীকে বিবৃতি দেন।
রাজধানী তেহরানের পূর্বাঞ্চলীয় আবসরদ শহরে নিজের গাড়িতে আততায়ীর বন্দুক হামলায় ফাখরিজাদে নিহত হন।
ইরান জোর দিয়ে বলে আসছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যবহারের উদ্দেশে।
ইরান কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচার হওয়া বিবৃতিতে রুহানি বলেন, দখলদার, ভাড়াটে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের মাধ্যমে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বৈশ্বিক শয়তান আবারো তার হাত রক্তে রঙিন করলো। শহীদ ফাখরিজাদের গুপ্তহত্যা প্রমাণ করে আমাদের শত্রুরা কতোটা হতাশ এবং তারা কতোটা বিদ্ধেষ পরায়ন। তার শহীদ হওয়া আমাদের অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
ইরানি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সামরিক উপদেষ্টা হোসাইন দেঘান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বজ্রপাতের মতো গুপ্তহত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
টুইট করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। বলেন, সন্ত্রাসীরা আরও এক বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করলো।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মাজিদ তাখত রাভাঞ্চি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। পুরো অঞ্চলের সর্বনাশ করার লক্ষ্যে ফাখরিজাদেকে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করে জারিফ বলেন, হত্যাকাণ্ডে ইসরাইলের ভূমিকা গুরুতরভাবে দৃশ্যমান।
২০১৮ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয় আলোচনার সময় ফাখরিজাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু।
হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখনও মুখ খোলেনি ইসরাইল। নিউইয়র্ক টাইমস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার দু’জনসহ তিন মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে জানিয়েছে, হামলার পেছনে ইসরাইল জড়িত।
ফাখরিজাদেকে হত্যার প্রেক্ষাপট কী?
ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে যখন নতুন করে উদ্বেগ বেড়েছে তখনই ফাখরিজাদের হত্যার খবর আসলো। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরমাণু অস্ত্র তৈরি, উভয় ক্ষেত্রেই ইউরেনিয়াম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে সই হওয়া চুক্তিতে ইউরেনিয়াম উৎপাদন সীমিত রাখতে রাজি হয় ইরান। ২০১৮ সালে ওই চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপর থেকে ইরান অব্যাহতভাবে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে চলছে।
জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ইরানের পরমাণু চুক্তিতে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যদিও এর বিরোধিতা করে আসছে ইসরাইল।
পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যার ঘটনাকে সন্ত্রাসী এবং অতিমাত্রায় বেপরোয়া কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক প্রধান জন ব্রেন্যান। বলেন, এ হত্যাকাণ্ড আঞ্চলিক সংঘাত আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
সিরিজ টুইটে তিনি বলেন, ফাখরিজাদের মৃত্যুতে প্রাণঘাতী প্রতিশোধের ভয়াবহতার পাশাপাশি নতুন করে আঞ্চলিক সংঘাত তৈরি করবে।
ব্রেন্যান আরও বলেন, তিনি জানেন না এ হত্যাকাণ্ডে বিদেশি কোনো সরকারের হাত রয়েছে কীনা, বা কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
মোহসেন ফাখরিজাদের সঙ্গে কী ঘটেছিল?
শুক্রবার এক বিবৃতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, মন্ত্রণালয়ের রিসার্চ এবং ইনোভেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান মোহসেন ফাখরিজাদেকে বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
সন্ত্রাসী এবং তার নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে সংঘাতের এক পর্যায়ে ফাখরিজাদে মারাত্মকভাবে আহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে চিকিৎসক দল তাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তিনি মারা যান।
ইরানের গণমাধ্যম জানায়, ফাখরিজাদেকে বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি চালায় হামলাকারীরা।
এর আগে ফার্স নিউজ এজেন্সি জানায়, অ্যাবসারদ শহরে একটি গাড়ি বিস্ফোরণ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানানো হয়, সেখানে তিন থেকে চারজন সন্ত্রাসী ছিল। যারা নিহত হয়েছে।
হামলার পর বন্দুকধারীদের কি হয়েছে তা এখনো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি।
ফাখরিজাদেকে কেন হত্যা করা হলো?
বিসিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদন পল অ্যাডামস জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিসার্চ এবং ইনোভেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান হিসেবে মোহসেন ফাখরিজাদে অবশ্যই একজন গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়ানক ছিলেন। দু’বছর আগে বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু সতর্ক করে বলেছিলেন এ নামটি মনে রাখবেন।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন শুরুর পর থেকে দেশটি দ্রুতগতিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে। যা চুক্তির শর্তের লঙ্ঘন। ইরানের কর্মকর্তারা বরাবর বলছে, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছু করছে। যা পুনরায় ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু তারা গবেষণায় যতোটা উন্নতি করেছে তা নির্মূল করা কঠিন।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার নিয়োজিত ইরানের সাবেক রাষ্ট্রদূত আলী আসগর সোলতানিয়াহ বলেন, আমরা পেছনে হটাতে পারি না।
ইসরাইলের অভিযোগ অনুযায়ী, মোহসেন ফাখরিজাদে যদি মূল ক্রীড়ানক হয়ে থাকেন এখন তার মৃত্যুতে ইরানের লক্ষ্যকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অন্য কাউকে এ দায়িত্ব নিতে হবে।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওয়াশিংটনকে ইরানের পরমাণু চুক্তিতে ফেরানোর কথা বলেছেন। নতুন এ হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যত সমঝোতাকে জটিল করে তুলতে পারে।
মোহসেন ফাখরিজাদে কে ছিলেন?
ফাখরিজাদে ইরানের খুবই বিখ্যাত একজন পরমাণু বিজ্ঞানী এবং দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যক্তি বলে পশ্চিমা নিরাপত্তা সূত্রগুলোর কাছে পরিচিত ছিলেন।
২০১৮ সালে ইসরাইলের হাতে আসা গোপন নথিতে বলা হয়, পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য তিনি একটি প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একই সময়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু ফাখরিজাদের নাম উল্লেখ করে ইসরাইলিদের এটি মনে রাখার জন্য বলেছিলেন।
২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস তাকে জে রবার্ট ওপেনহাইমারের সঙ্গে তুলনা করেন। জে রবার্ট একজন পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরির ক্ষেত্রে ম্যানহাটন প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাখরিজাদে ‘আমাদ’ নামে একটি প্রকল্পের নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৮৯ সালে প্রকল্পটি শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণার অভিযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ‘আমাদ’ নামের প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে ইসরাইলের হাতে যাওয়া গোপন নথির ভিত্তিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেন, ‘আমাদ’ প্রকল্পের অধীনে গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির হচ্ছে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাখরিজাদে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে অনুসন্ধানে ফাখরিজাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা।
ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে এমন সন্দেহ, ২০১০ সালে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘকে উদ্বুদ্ধ করে।
২০১৫ সালে ইরান যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া এবং জার্মানির সঙ্গে পরমাণু কর্মকাণ্ড সীমিতের শর্তে চুক্তি করে। বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে রাজি হয় সবপক্ষ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পরই শর্ত ভাঙতে শুরু করে ইরান। চলতি মাসের শুরুতে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা জানায়, চুক্তির শর্তের থেকে ১২ গুণ বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে ইরান।
জানুয়ারিতে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কুদস শাখার কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর দু’পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন