পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কীভাবে শুরু হয়?

পহেলা বৈশাখের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রা বের হয়। শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য জেলাশহরেও মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস

বৈশাখী সালের ইতিহাস কয়েকশো বছরের পুরনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব পুরনো নয়। ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে প্রথম এই শোভাযাত্রা বের হয়। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে এই শোভাযাত্রা পুনরায় চারুকলার গেটে এসে সমাপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ধর্ম নিরপেক্ষ একটি উৎসব হিসেবে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন জেলা সদরে পালিত হয়ে আসছে মঙ্গল শোভাযাত্রা।

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল – পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলায় ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালিত হয়ে থাকে।

মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি রাজনৈতিক ইতিহাসও রয়েছে। ১৯৮০ দশকের স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে একটি অবস্থানও ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য। অশুভ শক্তির বিপক্ষে শুভশক্তির সূচনা করতেই শোভাযাত্রার শুরু হয়।

শুরুতে এর নাম আনন্দ শোভাযাত্রা ছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখেই এমনটা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবেই পরিচিত হয়।

কারা অংশ নেন?

এই শোভাযাত্রা সবার জন্য উন্মুক্ত। বিভিন্ন শ্রেণিপেশা এবং ধর্মের মানুষেরা এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন।

অনুষঙ্গ

এই শোভাযাত্রা বর্ণিল রঙে রাঙা। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন লোকজ উপাদান এই শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়। এই শোভাযাত্রা উপলক্ষে বানানো হয় বিভিন্ন মুখোশ, মূর্তি, ট্যাপা পুতুল, নইশি পাখি, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি।

১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়।

শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।

স্বীকৃতি

বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।