‘প্রধানমন্ত্রী খালা, তারপরও আমি ১১ মামলার আসামি’
আন্দালিব রহমান পার্থ। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি লম্বা নয়। তবে এরই মধ্যে পেয়েছেন বিপুল পরিচিতি। পিতা প্রয়াত রাজনীতিবিদ নাজিউর রহমান মঞ্জুর। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। পার্থ’র মা শেখ পরিবারের মেয়ে। দু’দিক থেকেই দুই মেরুর রাজনীতিবিদদের দেখেছেন। শিখেছেন তাদের কাছ থেকে। ছোটবেলা থেকেই বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জুর তাকে কাছাকাছি রাখতেন। তার বাবা বলতেন, ‘তোমাকে পলিটিক্স করতে হবে। পলিটিক্স হঠাৎ করে করা যায় না। এজন্য রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।’
পার্থ বলেন, বাবা ছোটবেলা থেকেই আমাকে সঙ্গে রাখতেন। খেলতে যেতে চাইলেও আমাকে তার পাশে বসিয়ে রাখতেন। যাকাত দিলেও বাবা বলতেন ‘তোমার হাত দিয়ে দাও, অভ্যাস করো।’ বাবা দান করতে পছন্দ করতেন। আমি সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্রবস্থায় ঢাকা থেকে আমাকে নিয়ে ভোলা যেতেন। জনসভার মঞ্চে বাবা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। আশপাশে বসে থাকতাম আমি। বক্তব্য শুনতাম। মানুষের সে কি ভালোবাসা বাবার প্রতি- তা দেখে অভিভূত হতাম। বাবার কাছকাছি থাকার কারণে ইলেকশন মনিটরিং, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কীভাবে করতেন তা শিখেছি। শৈশব থেকেই পার্থর কাছে হিরো বলতে রাজনীতিবিদরাই।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশিরভাগ সময়ই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আশপাশে ঘোরাফেরা করতাম। আমার হিরোই ছিল পলিটিশিয়ানরা। বাবা রাজনীতিবিদ। অন্যদিকে মামা শেখ ফজলুল হক মনি। তাই মামার বাড়িতেও বড় বড় পলিটিশিয়ানরা আসা-যাওয়া করতেন। আমি এসব দেখে দেখেই শিখেছি। যে কারণে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে মিশে যেতে কষ্ট হয়নি। যদি ছোটবেলায় রাজনৈতিক শিক্ষা না পেতাম তাহলে হয়তো এমপি, মন্ত্রী হতাম কিন্তু রাজনৈতিককর্মী বা নেতা হতে পারতাম না।
পার্থ জানান, আইন নিয়ে লেখপড়া করেছি রাজনীতি করার জন্যই। সেন্ট যোসেফ ও ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ালেখা করেছেন পার্থ। তারপর ১৯৯১ সালে চলে যান ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডে এ লেভেল করেন। ১৯৯৫ সালে এলএলবি করেন সেখানেই। এরমধ্যেই একটি মামলায় কারাবন্দি হন পার্থ’র বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জুর। পার্থ ছুটে আসেন দেশে। প্রায় এক বছর দেশে থাকেন। তারপর আবার লন্ডনে। ১৯৯৭ সালে বার এট ল’ করে দেশে ফিরেন তিনি। ইংল্যান্ডের উলভার হ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন তিনি। দেশে ফিরে চার বছর কাজ করেন প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে।
তারপর ২০০১ সাল। পুরোদমে রাজনীতিতে সময় দেন পার্থ। কাজ শুরু করেন নিজের এলাকা ভোলায়। পিতার গড়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)’তে কোনো পদ-পদবি নেই তখন। তাতে কী কর্মী হিসেবে কাজ করেন। অল্প দিনেই মানুষ তাকে গ্রহণ করে। নির্বাচন করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। বিজেপি তখন চারদলীয় জোটে। পার্থ নির্বাচন করতে চান ভোলা-৪ আসনে। কিন্তু জোটের মনোনয়ন পাননি। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি। আসে ১/১১।
পার্থ বলেন, দেশে আসার পর থেকে সবসময়ই মানুষের সেবায় ব্যস্ত ছিলাম। এরমধ্যেই ২০০৮ সালের ৬ই এপ্রিল মারা যান ভোলাবন্ধু খ্যাত নাজিউর রহমান মঞ্জুর। তারপর পার্থ দায়িত্ব নেন বিজেপি’র। ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে পিতার নির্বাচনী আসন ভোলা-১ থেকে নির্বাচন করেন বিজেপি’র চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ।
এ বিষয়ে পার্থ বলেন, ওই নির্বাচনে সারা দেশে চার দলীয় জোটের অনেক বাঘা বাঘা নেতারা ফেল করেছেন। কিন্তু ভোলার মানুষ আওয়ামী লীগের তৎকালীন একজন প্রেসিডিয়াম মেম্বারের বিপরীতে আমাকে জয়ী করেছে। ওই এলাকার মানুষ আমার বাবাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। তখন তো মানুষ সেভাবে জানতো না আমাকে। শুধু নাজিউর রহমান মঞ্জুর কথা চিন্তা করেই মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। আমি মনে করি আমার বাবা ভোলার সার্ভেন্ট। সার্ভেন্ট মারা গেলে তার সন্তানের দায়িত্ব যেভাবে গৃহকর্তা নেন ঠিক সেভাবেই ভোলাবাসী আমার দায়িত্ব নিয়েছেন। ঘোর আওয়ামী লীগের কর্মীরাও আমাকে ভোট দিয়েছে। তাদের এই ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। এখনও ভোলাবাসী আমাকে ভালোবাসে। আমি সবসময় তাদের পাশে থাকতে চাই।
ভোলা-১ আসনের সাবেক এমপি আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আমি সরকারি দলের এমপি ছিলাম না। কাজের সুযোগ হয়নি। তবু যতটুকু সম্ভব এলাকার জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। এমপি থাকাবস্থায় জিরো পরিমাণ দুর্নীতি করিনি, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেইনি। কোনো আত্মীয়করণ করিনি। এজন্যই ভোলার মানুষ তার পাশে আছে বলে মনে করেন তিনি। পার্থ বলেন, রাস্তা, ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যাবে। আমি ওই এলাকার শিক্ষার মান বৃদ্ধি, মাদকমুক্ত ও দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই। নদীভাঙন রোধ করতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবো।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে আরও শক্তিশালী করতে চান। আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আমি মনে করি আমার ব্যক্তিগত গ্রহণযোগতা অনেক বাড়াতে হবে। অনেক ভালো কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে আগ্রহী করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে। বিশ্বাস করি এরপরে একটা ভালো সময় আসবে। গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে পুঁজিবাদী, চোর-বাটপাররা রাজনীতিতে এসেছে। ভালো মানুষ আসেনি। মেধাবী, সৎ তরুণদের বসে থাকলে চলবে না। রাজনীতিতে আসতে হবে। নতুবা অসৎ ব্যক্তিরা এখানে অবাধ সুযোগ পেয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে রাজনীতি শেখার বিষয়। হঠাৎ করেই রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। অনেকে রাজনীতি করতে চায় কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা রাজনীতি করতে চায় না। তারা মূলত এমপি, মন্ত্রী হতে চায়। এমপি মন্ত্রী হওয়া আর রাজনীতি করাতো এক না। ক্রিকেটে দেখেন আকরাম খানদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সাকিব আল হাসানরা এসেছে। এখন তো আকরাম খানদেরও তারা ছাড়িয়ে গেছেন। এভাবেই আজ যে তরুণরা আসবে তারা রাজনৈতিক শিক্ষা নিয়েই আমাদের ছাড়িয়ে যাবে।
সুবক্তা হিসেবে জনপ্রিয় আন্দালিব রহমান পার্থ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেন ১৯৯৬ সালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ভোলার একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে। এটি তার বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জুর সঙ্গে নেতাকর্মীদের পুনর্মিলনী। তারপর থেকে শুরু। অনেকেই মনে করেন শেখ পরিবারের আত্মীয় ও বিএনপি চেয়ারপারসনের স্নেহভাজন হিসেবে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কথা বলেন পার্থ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সত্য প্রধানমন্ত্রী আমার খালা, পরে ফুফু শ্বাশুড়ি। তারপরও আমি ১১টি মামলার আসামি। কারাগারেও ছিলাম। আমি যা বিশ্বাস করি তা-ই বলি। আমার বক্তব্য তো কেউ ড্রাফট করে দেয় না। ২০ দলীয় জোটের সকল কর্মসূচিতে আমি সক্রিয় থাকি। এটাই রাজনীতি।
পার্থর জন্ম ১৯৭৪ সালের ২০শে এপ্রিল ধানমন্ডির একটি ক্লিনিকে। তার মা শেখ রেবা রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাইঝি ও শেখ ফজলুল হক মনি ও শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বোন। নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও শেখ রেবা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে পার্থ প্রথম। দ্বিতীয় ড. আশিকুর রহমান শান্ত একজন অর্থনীতিবিদ, সবার ছোট ওয়াছিকুর রহমান অঞ্জন ব্যারিস্টার। পার্থ বিয়ে করেছেন ২০০০ সালের মার্চে। পূর্ব আত্মীয়তার সূত্রধরেই বঙ্গবন্ধুর ভাতিজা শেখ হেলালের মেয়ে শেখ সায়রা রহমানকে বিয়ে করেন তিনি। এই দম্পতির তিন সন্তান। মাহাম সানজিদা রহমান (১২), মাদিনা বিনতে আন্দালিব (৮) ও আড়াই বছর বয়সী মোহাম্মদ ইবনে আন্দালিব। স্ত্রী সায়রা সংসার সামলান।
পার্থ ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি নিয়ে। দেশ-বিদেশের পত্রিকা পড়েন। এছাড়া সুযোগ পেলেই বই পড়েন। রাজনৈতিক বই, রাজনীতিবিদদের জীবনী। পাশাপাশি ব্রিটিশ স্কুল অব ল’র অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পার্থ বলেন, আমি মানুষের সেবা করতে চাই। রাজনীতির মাধ্যমে তা সহজেই করা সম্ভব। আমি বাবাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। বাবা রাজনীতি শিখতে বলতেন। জ্ঞান অর্জনের শেষ নেই। আমি প্রতিনিয়ত রাজনীতি শেখার চেষ্টা করি। সূত্র: মানবজমিন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন