প্লাস্টিক কাপে ক্যান্সার জীবাণু, গরম পানীয় পরিবেশন নিষিদ্ধ করা জরুরি
বর্তমানে সারাবিশ্বে একক ব্যবহারে উপযোগী ( Single use) প্লাস্টিকের কাপের ব্যবহার সর্বত্র। যা ছোট টংয়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস, রেস্টুরেন্ট সহ নানা জায়গায় পানীয় পরিবেশনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কোভিট-১৯ মহামারী চলাকালীন সময় থেকে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকে বিবেচনায় চা, কফি, কোমল পানীয়, লাচ্ছিসহ দুধের তৈরি বিভিন্ন পানীয় পলিস্টাইরিন (polystyrene) প্লাস্টিকের তৈরি একক ব্যবহারে উপযোগী কাপগুলিতে পরিবেশন করা আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার ও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চলছে ব্যাপকভাবে গবেষণা। সম্প্রতি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবির) একদল গবেষকের গবেষণায় পলিস্টাইরিন (polystyrene) তৈরি প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহারের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি, বিশেষ করে কিডনি, ফুসফুস, লিভার ক্যান্সারের মতো জীবন নাশক মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী ভারী ধাতুর উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে। যা প্লাস্টিক কাপ থেকে খুব সহজে স্থানান্তরিত হয়ে পানীয়তে ও পরবর্তীতে মানব দেহে প্রবেশ করে।
গবেষক দলটি বিভিন্ন একক ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক কাপে চা, কার্বনেটেড কোমল পানীয়, লাচ্চি সহ বিভিন্ন রকম কোমল পানীয় যথাক্রমে এক, পাঁচ ও দশ মিনিট ধরে রেখে পরীক্ষা করে ২০ টি নমুনার ১৭ টি নমুনাতেই মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতুর (কপার, লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম) উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। গবেষণা পত্রটি সম্প্রতি “Study on the effect of different contact times on the migration of heavy metals into different foodstuffs served in plastic cups” শিরোনামে (Heliyon, Q1, IF:4.0) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণা পত্র অনুযায়ী, পলিস্টাইরিন তৈরি একক ব্যবহারে উপযোগী কাপে পরিবেশিত খাদ্য ও পানীয় এবং উভয়ের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যোগাযোগের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত প্রভাবের উপর সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি নিবন্ধন করা হয়। ভারী ধাতুর সমূহ যেমন লেড, ক্যাডমিয়াম এবং আর্সেনিক এরা ক্যান্সার সৃষ্টিকারক (carcinogens) হিসাবে পরিচিত,যার দীর্ঘমেয়াদী লিভার, কিডনি এবং ফুসফুসের রোগ সহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে পরিচিত। শুধু তাই নয় এ ধরনের ভারি ধতু সমূহের নন-কার্সিনোজেনিক( non-carcinogenic) প্রভাব যেমন শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা (হাঁপানি, পালমোনারি ডিজিজ) হার্টের সমস্যা, প্রজননের উপর প্রভাব,হরমোন সিস্টেমের উপর প্রভাব ও স্নায়ুবিক প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবেও পরিচিত। গবেষক দলটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে একক ব্যবহারে উপযোগী প্লাস্টিকের এই কাপগুলোতে যত বেশি সময় ধরে খাবার বা পানীয় থাকবে ভারী ধাতু গুলো তত বেশি স্থানান্তরিত হবে।যার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা আরো বেশি হবে।
গবেষক দল যশোর শহরের বিভিন্ন দোকান থেকে দৈব চয়নের মাধ্যমে পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য পলিস্টাইরিন প্লাস্টিকের তৈরি একক ব্যবহারে উপযোগী ২০ টি কাপ সংগ্রহ করে। পাশাপাশি চিনি,চা, কোমল পানীয়, এবং লাচ্ছির নমুনা তৈরি করে নির্দিষ্ট নিয়মে ও সর্বোচ্চ সতর্কতার সহিত সেগুলোর পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর ১৭ টি নমুনায় ভারী ধাতুর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি তারা একই খাদ্যপণ্যগুলো সাধারন কাচের পাত্রে পরীক্ষা চালিয়ে কোন ভারী ধাতুর উপস্থিতর প্রমাণ পাননি । গবেষণায় গ্রাফাইট ফার্নেস পারমাণবিক শোষণ স্পেকট্রোফোটোমেট্রি(GFASS) ব্যবহারে করে প্রমাণ করে যে সমস্ত নমুনায় প্লাস্টিক কাপে বিভিন্ন পরিমাণে ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে কপার তারপর লেড,ক্রোমিয়াম এবং ক্যাডমিয়াম। এসমস্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে গবেষক দল স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা নির্ণয় করেছেন।
এ বিষয়ে গবেষক দলের প্রধান ও এগ্রো প্রডাক্ট প্রসেসিং টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বি.এম খালেদ বলেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের দেশে সর্বত্র বিরাজমান। প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এটি মাটিতে মিশে যায় না।এছাড়াও বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা একক-ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক থেকে ভারী ধাতু খাবারে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন । কিন্তু তাদের গবেষণায় দেখা গেছে কেউ ১ঘণ্টা, কেউ বা তার চেয়ে অধিক সময়ে খাবার প্লাস্টিক কাপে রেখে সেই সময়ের মধ্যে খাবারে স্থানান্তরিত ভারী ধাতুর উপস্থিতি নির্ণয় করেন। কিন্তু কোন গবেষণায়, আমরা ঠিক যে সময়ের মধ্যে খাবারটি বা পানীয়টি খায়, সেই সময়ের মধ্যে ভারী ধাতুর স্থানান্তর হওয়ার হার দেখা হয় নি। তাই আমি ও আমার দল এই বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করি।
তিনি আরো জানান, আমরা চা, কার্বোনেট জাতীয় পানীয় ও লাচ্ছি প্লাস্টিক কাপে রেখে নির্দিষ্ট সময় পরপর (১ থেকে ১০ মিনিট) তাতে ভারী ধাতুর পরিমাণ কিরূপ তা নির্ণয় করি। এই সময়কাল নির্বাচন করার কারণ হলো সাধারণ পানীয় তা গরম কিংবা ঠান্ডা হোক, আমরা এই সময়ের মধ্যেই খেয়ে থাকি সাধারণত। এরপর আমরা USEPA প্রটোকল অনুযায়ী নমুনাতে উপস্থিত ভারি ধাতুর পরিমাণ অনুযায়ি মানবদেহের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিরূপন করি।এতে দেখা যায়, এসিড জাতীয় খাবার যেমন কার্বোনেট জাতীয় পানি, গরম খাবার যেমন চা ইত্যাদিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। যার ফলে একক-ব্যবহার উপযোগী কাপে যত বেশি সময় পানীয় বা খাবার থাকবে তার স্বাস্থ্যঝুকি বা ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। তাই একক-ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে আমরা মাটির তৈরি কাপ বা কাগজের কাপ ব্যবহার করতে পারি ।
এছাড়াও গবেষণা দলের অন্য সদস্যরা হলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিরাপদ খাদ্য অফিসার আদ্দা আন সিনা, এগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব এস.এম. শামিউল আলম, সহকারী অধ্যাপক জনাব মোঃ সুমন রানা, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান, মারিয়া তাবাসসুম শাম্মী, ফাতিমা পারভীন, তামান্না নাজনীন, মোঃ মোজাফফর হোসেন ও রিফাত পারভীন অনন্যা।
গবেষণা পত্রের লিঙ্ক: https://doi.org/10.1016/j.heliyon.2024.e31627
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন