বন উজাড় করছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে দেশের সীমিত বনাঞ্চল রক্ষায় সরকার একদিকে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে বন নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে সরকারের কোনো কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে। এবার স্থানীয় সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে নানা স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে বন অধিদফতরের আওতাধীন বন উজাড়ের অভিযোগ তুলেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
অননুমোদিতভাবে বনের মধ্যে যত্রতত্র রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ থেকে বিরত থাকার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এছাড়া বন নষ্ট করে বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ না করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর এ চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকেও চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের সীমিত বনভূমি যথাযথ সংরক্ষণের বৃহত্তম স্বার্থে জাতীয় বননীতিতে বনভূমির বনায়ন ছাড়া ভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০০২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির নির্দেশনা অনুযায়ী বনের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ, একান্ত প্রয়োজন হলে রাস্তা নির্মাণের আগে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পিসিপি (প্রজেক্ট কনসেপ্ট পেপার- প্রকল্পের ধারণাপত্র) বা পিপি (প্রকল্পের ছক) তৈরির সময় বন অধিদফতর কিংবা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
গত ২৯ মার্চ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩২তম সভায়ও এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জানিয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়, তা সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ইত্যাদি সংস্থা বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক শালবন ও সৃজিত সামাজিক বনের ক্ষতিসাধন করে বনের মধ্যে অননুমোদিতভাবে যত্রতত্র রাস্তা, ড্রেন, বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের জন্য মাঠপর্যায়ে তৎপর রয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এসব নির্মাণকাজ অননুমোদিতভাবে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নকালে বন বিভাগের কর্মীরা বাধার সম্মুখীন হন। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হয়। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অনেকক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকেও ভুল বুঝিয়ে বন বিভাগ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দেয়া হয়। এতে জনসাধারণের কাছে বন বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেও দায়িত্ব পালনে কঠিন সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। সীমিত জনবল ও লজিস্টিক দিয়ে বন বিভাগের পক্ষে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, সংবিধানে ‘পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শিরোনামে ১৮ এর ক অনুচ্ছেদ নিম্নরূপভাবে সংযোজন করা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
এ প্রেক্ষাপটে সরকারি বনাঞ্চলে রাস্তা, ড্রেন কিংবা যেকেনো উন্নয়ন প্রকল্প মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩২তম সভার সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে অনুসরণের জন্য স্থানীয় সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘সংরক্ষিত বনের মধ্যে আমাদের অনুমোদন ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না। কিন্তু গাজীপুরে হচ্ছে, কক্সবাজারেও তাই হচ্ছে। কিন্তু যারা এগুলো করছেন তারাও তো সরকার, তাদের তো এগুলো জানা উচিত। সবাই বনের মধ্যে যাচ্ছে, কী করব বলুন?’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘একান্ত প্রয়োজন না হলে বন নষ্ট করে স্থাপনা নির্মাণে নিরুৎসাহিত করা হয়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একটা ট্রান্সমিশন লাইন হবে, আমাদের বেশ বড় বনাঞ্চলের মধ্যে এটা পড়ে গেছে। আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠাব। প্রধানমন্ত্রী সহজে গাছ কাটার অনুমতি দেন না।’
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুর রেঞ্জে এলজিইডির গোসিংগা-রাজাবাড়ী রাস্তা নির্মাণ, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বারতোপা-সিমলাপাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন নিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি জানান, গাজীপুরে কাচিঘাটা ও কালিয়াকৈর রেঞ্জের বনাঞ্চলের মধ্য দিয়েও বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া রাস্তা নির্মাণ করছে এলজিইডি। এছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের জন্য বনের মধ্যে পিলার নির্মাণ এবং কালিয়াকৈরে পৌরসভার ড্রেন ও রাস্তার নির্মাণ হচ্ছে। সেখানেও জনগণকে বন বিভাগের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে।
এদিকে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বনের মধ্যে অননুমোদিতভাবে কোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চিঠির বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমার চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ, সাড়ে ৪০০ উপজেলা পরিষদ, কে কোন দিক দিয়ে বন কেটে রাস্তা বানালো সেই খবর আমি কীভাবে রাখব? এটা কি আমার পক্ষে দেখা সম্ভব? তবে এ ধরনের ঘটনা চোখে পড়লে আমরা ব্যবস্থা নেই, আমরা কাজ বন্ধ করে দেই।’
বন অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৫ লাখ ৭৯ হাজার ৩৮৭ হেক্টর। যা দেশের মোট আয়তনের ১৭ দশমিক ৪৭৯১ শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন।
গত বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের বনাঞ্চল ও কৃষিজমি নিয়ে ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফরেস্ট-২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানায়, গত ২৫ বছরে (১৯৯০ থেকে ২০১০) বাংলাদেশের ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি কমেছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে কমেছে ১৩ হাজার হেক্টর। সূত্র : জাগো নিউজ
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন