বাংলাদেশে ধর্ষণের ভয়াবহতা বাড়ছেই
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। চলন্ত বাসে ধর্ষণ নতুন নয়। প্রায়ই ঘটছে। ২০১৯ সালের প্রথম চার মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে ৬৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ১৮ জন।
শহুরে ব্যস্ততায় কিংবা গ্রামের নির্জনতায় কর্মস্থলে, গণপরিবহনে-সর্বত্রই ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ধর্ষণের ঘটনা। এখন আর উত্ত্যক্ত করা বা ইভটিজিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। সুযোগ পেলেই বিকৃত রুচিসম্পন্ন কতিপয় মানুষরূপী নরপশু হামলে পড়ছে নারীর ওপর। হিংস্র হায়েনার নখ বসিয়ে দিচ্ছে তরুণী, কিশোরী এমকি শিশুর গায়েও। হরণ করে নিচ্ছে একজন নারীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্বল। গ্রেফতার, সামাজিক ধিক্কার, আইনের প্রয়োগ, এমনকি জেল জরিমানাতেও থামানো যাচ্ছে না কামুক ধর্ষকদের।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে সারা দেশে চার হাজার ৬৪২টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল চার হাজার ৫৩৮টি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ৭৯৭টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হচ্ছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশের আদালতগুলোতে ঝুলে আছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দেড় লক্ষাধিক মামলা। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা; আর সাজা পাচ্ছে হাজারে সাড়ে ৪ জন আসামি।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ১০ বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ১১৭টি। এর মধ্যে রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২১টির, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। মামলার অনুপাতে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ শতাংশ, সাজার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বর্তমানে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এক বছর বয়সী শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা এ বর্বরতার শিকার হচ্ছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ৮০ জনের বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৮ বছর। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ৩৫ শতাংশ। আর চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসেই (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৬২ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ২৯ শতাংশ।
২৬২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই (জানুয়ারি থেকে জুন) ২৮০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ৮০ জন শিশুর বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ২৯ শতাংশ। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ৫৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ২১ শতাংশ, এক থেকে ৬ বছরের ৩০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ১১ শতাংশ। ১১১ জন শিশুর বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। যার হার ৩৯ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ২২৭ জন শিশু। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৮০। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ৩৫ শতাংশ। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ৭০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ৩১ শতাংশ, এক থেকে ৬ বছরের ৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ২৫ শতাংশ। ২১ জন শিশুর বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। যার হার ৯ শতাংশ।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রকাশিত রিপোর্টে ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা বলা হয়। বাস, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা ও ট্রাকে এসব ঘটনা ঘটে। গণপরিবহনের চালক- হেলপারসহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়েছে।
গণপরিবহনে গণধর্ষণের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জে শুভেচ্ছা পরিবহনের চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ, ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে চলন্ত বাসে পোশাককর্মী ধর্ষণ, একই বছর ঢাকায় এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণ, ২০১৬ সালে বরিশালে সেবা পরিবহনের একটি বাসে পাঁচ পরিবহনকর্মী মিলে দুই বোনকে ধর্ষণ, একই বছরে টাঙ্গাইলে একটি বাসে এক পোশাককর্মী ধর্ষণ, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে বাসে এক কিশোরী ধর্ষণ এবং সর্বশেষ গত ৬ মে কিশোরগঞ্জে শাহীনুর ওরফে তানিয়া নামে এক নার্সকে বাসের ভেতর ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। শেষ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুলিশ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের দায়ে বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু (৩৯), বাসের হেলপার লালন মিয়া (৩২), রফিকুল ইসলাম রফিক (৩০), খোকন মিয়া (৩৮) এবং বল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুলকে (৫০) গ্রেফতার করে। পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা তানিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার কথা স্বীকার করে এবং ১১ মে কিশোরগঞ্জ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
এসব বিষয়ে নারীনেত্রী ও মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, আইনের প্রয়োগের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা, বিকৃত রুচিসম্পন্ন হীন মানসিকতাসহ নানা কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এসব রোধে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি। আর এটা করতে হলে সামাজিক সচেতনতা আর আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। যা বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
এর মাঝে অপরাধ বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, আমাদের সামাজিক লিডার বলতে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, পুরোহিত ও সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা একসময় এসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু এখন সবাই আত্মকেন্দ্রিক আচরণ করছেন। ফলে সামাজিক আচরণের পরিবর্তে এক ধরনের ব্যক্তিস্বার্থের বিষয় কাজ করে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসামিরা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং ভিকটিমদের হুমকি দেয়, ভয়ভীতি দেখায়। ফলে অধিকাংশ মামলাই আলোর মুখ দেখে না। এ ধরনের ঘটনায় দু-একটি বিচার হলে সেটা কিন্তু প্রকৃত দৃষ্টান্ত না। বিচার হতে হবে কঠিনভাবে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন