‘বিদেশি সহায়তা প্রতারণা মাত্র, পায় না গরিব দেশগুলো’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব পাঁচটি দেশ হচ্ছে কঙ্গো, মোজাম্বিক, উগান্ডা, তাজিকিস্তান এবং হাইতি। এটা দেখে কেউ কেউ মনে করতে পারেন এসব দেশ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা পেয়ে থাকে। এমন ভাবলে তারা ভুল করবেন।
প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়ে থাকে পাকিস্তান, সিরিয়া, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও আফগানিস্তান। সবচেয়ে গরিব পাঁচটি দেশের একটাও সবচেয়ে বেশি ব্রিটিশ সহায়তা পাওয়া ১০টি দেশের তালিকায় নেই।
গত সপ্তাহে আফ্রিকা সফরের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ঘোষণা করেন ব্রেক্সিট ছাড়ার পর ব্রিটেনের সহায়তা ব্রিটেনেরই বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হবে। তবে, সত্যিটা হচ্ছে ইতোমধ্যেই প্রদত্ত সহায়তাও ঠিক এই কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে।
ব্রিটেন এখন সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিচ্ছে সেসব দেশকে, যেগুলো বাজার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- নাইজেরিয়া, অথবা ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের (ওয়ার অন টেরর)’ কারণে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সিরিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকার জন্যও একই কথা সত্য। পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলো আমেরিকার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়া দেশের তালিকায় নেই। তাদের বেশিরভাগ সহায়তা যায় ইসরাইল, মিশর, জর্ডান, আফগানিস্তান এবং কেনিয়ায়। এরাও সহায়তা পায় বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে।
সরাসরি সহায়তা দেয়ার বদলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে দেয়া সহায়তার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এই সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়া ১০টি দেশের তালিকাতেও দরিদ্রতম কোনো দেশ নেই।
ডানপন্থীরা বৈদেশিক সহায়তা অত্যন্ত অপছন্দ করে। তাদের যুক্তি হচ্ছে এই টাকা দেশেই খরচ করা উচিত। পৃথিবীর সম্পদ পুনর্বন্টনের ব্যবস্থা হিসেবে বামপন্থিরা এই সহায়তাগুলোর প্রশংসা করে থাকে। কিন্তু চ্যারিটি বা দান হিসেবে এসব সহায়তা দেয়া হয় না- বাণিজ্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে এগুলো দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তার অর্ধেকই দেয়া এই শর্তে যে, সহায়তা গ্রহণকারী দেশ দাতা দেশের কাছ থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয় করবে। ইউএস এইডের ওয়েবসাইটে গর্ব করে বলা ছিল, ‘আমেরিকার বৈদেশিক সহায়তা প্রকল্প থেকে সবসময়ই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র নিজে। ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর চুক্তি ও অনুদানের প্রায় ৮০ শতাংশই সরাসরি যায় আমেরিকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সহায়তা দিয়ে আমেরিকার শিল্পপণ্য রফতানির বাজার তৈরি করা হয়েছে এবং এর ফলে আমেরিকার লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।’
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে থেকেই ইউএস এইড ‘আমেরিকাকে অগ্রাধিকার (America first)’ দিচ্ছিল। এই অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত বিব্রতকর হয়ে ওঠায় ২০০৬ সালে এটি ডিলিট করে দেয়া হয়।
বৈদেশিক সহায়তার বেশিরভাগটাই দেয়া ঋণ হিসেবে, যার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এগুলো আরও পঙ্গু হয়ে যায়। অনেক উন্নত দেশ যতটা ‘সহায়তা’ দেয় সুদ হিসেবে সাহায্য গ্রহণকারী দেশের কাছ থেকে তারা আরও বেশি টাকা পেয়ে থাকে।
বিশেষত, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধসের পর পশ্চিমা দেশের সরকারগুলো সহায়তা প্রকল্পের জন্য কম সুদে ঋণ নেয়ার সুবিধা কাজে লাগায়। কম সুদে ঋণ নিয়ে সহায়তা প্রকল্প দাঁড় করিয়ে তারা চড়া সুদে ওই টাকা গরিব দেশগুলোকে দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। এটা আসলে সহায়তা নয়, কেলেঙ্কারি।
ব্রিটেন ঐতিহ্যগতভাবে ঋণের চাইতে অনুদান হিসেবে বেশি সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু, ২০১৪ সালে একটি কমিটি ঋণের ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানায়। থেরেসা মে’র কেপ টাউনের ভাষণে পরিষ্কার দেখা গেছে তিনি সহায়তাকে বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন।
সহায়তা শুধু ধনী দেশগুলোর অর্থনীতিকেই শক্তিশালী করে না, একই সঙ্গে তাদের পররাষ্ট্রনীতিকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০১৪ সালে ইউএস কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সহায়তা ‘লাঠি হিসেবেও ব্যবহার করা যায় মুলা হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এটা বিভিন্ন ঘটনাকে প্রভাবিত করা, নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান করা এবং মার্কিন মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার উপায় হিসেবেও কাজ করে।’
স্নায়ুযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট-বিরোধী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা দেশগুলো সহায়তা প্রকল্প ব্যবহার করতো। ৯/১১-এর পর থেকে এটা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সহায়তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সাম্প্রতিকতম ইস্যু হচ্ছে মাইগ্রেশন বা অভিবাসন। বিশেষত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) সহায়তা দেয়ার জন্য আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ইউরোপে যাওয়া শরণার্থীর সংখ্যা কমানোর শর্তকে ক্রমেই আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
২০১৬ সালে ইইউ’র একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেসব দেশ আমাদের সঙ্গে কাজ করবে তাদের সঙ্গে বিশেষ আচরণ করা হবে। যারা করবে না বা পারবে না তাদের সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করা হবে এবং আমাদের বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে সেটা বুঝিয়ে দেয়া হবে।’ প্রদত্ত সহায়তাকে ইইউ সবচেয়ে ভালো অবস্থায় এক ধরনের ঘুষ এবং সবচেয়ে বাজে অবস্থায় ব্ল্যাকমেইল করার উপায় হিসেবে দেখে।
শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই এরকম আচরণ করে না। সাহায্য দেয়ার আন্তর্জাতিক ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা চীনও এখন একইভাবে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে সহায়তাকে ব্যবহার করছে। তারাও সহায়তা দেয়ার সময় তাদের পণ্য ও সেবার বিক্রি বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেয়।
পৃথিবীর দক্ষিণে অবস্থিত দেশগুলোর জন্য উন্নয়ন প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহায়তা দুর্যোগের সময় ত্রাণ হিসেবে বা অন্যান্য অনেকভাবে দেয়া হতে পারে, যা জরুরি ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে বৈদেশিক সহায়তা একটা প্রতারণা মাত্র। এটা মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে নয়, বরং তা আরও বাড়িয়ে তোলার উপায় হয়ে উঠেছে।
(ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত কেনান মালিকের প্রবন্ধ থেকে অনুদিত। মালিক একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক, শিক্ষক, ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন