আমরা কর্মবিমুখ জাতি গড়তে চাই না : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার কোনোভাবেই কর্মবিমুখ জাতি গড়ে তুলতে চায় না; বরং যার যা কর্মদক্ষতা আছে, তা কাজে লাগিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে চায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্মবিমুখ জাতি গড়ে উঠুক, সেটা আমরা চাই না। বরং যার যা কর্মদক্ষতা, কর্মশক্তি আছে, সেটাকে যেন তারা কাজে লাগাতে পারে, সেদিকেই দৃষ্টি দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় সমাজসেবা দিবস-২০১৮’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যে বিধবা-বয়স্ক ভাতা দিই, তার একটি লক্ষ্য আছে। সেখানে আর একটি বিষয় আমরা লক্ষ্য রাখি তা হলো কেউ যেন সম্পূর্ণভাবে ভাতার ওপর নির্ভরশীল না হয়। যে কর্মক্ষম, সে কাজ করে খাবে। কিন্তু সে যেন কোনোভাবেই অভুক্ত না থাকে, সেদিকে আমরা লক্ষ্য রেখে অন্তত মাসে যেন ১০ কেজি চাল কিনতে পারে, তার সমপরিমাণ এবং সঙ্গে কিছু বেশি টাকা দিচ্ছি। শুধু ভাতার ওপরই যেন তারা নির্ভরশীল না হয়, যার যার কর্মক্ষমতা আছে সে যেন কাজ করে নিজের উপার্জন বাড়াতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এ ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. মো. মোজাম্মেল হোসেন বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিল্লার রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের সদস্য, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, আমন্ত্রিত অতিথি এবং সমাজসেবা মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন উপকারভোগী ও প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি যে সংবিধান দিয়েছেন, সেই সংবিধানেই অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল।’ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেন সরকার ও দেশের কাছ থেকে সমানভাবে সুযোগ পায়, তিনি সেটা তিনি নিশ্চিত করে দিয়ে যান।
প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৯ সালে তাঁর সমাজসেবা ভবন উদ্বোধনকালে প্রতিবছর ২ জানুয়ারি সমাজসেবা দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়ার কথা স্মরণ করেন এবং বলেন, ‘১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমরা প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য প্রথমবারের মতো বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা চালু করি। পরে সব ভাতার পরিমাণ ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমরা ৩৫ লাখ প্রবীণ ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতা দিচ্ছি। এ বছর ১২ লাখ ৬৫ হাজার নারীকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে বিধবা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ খাতে বছরে ৭৫৯ কোটি টাকা প্রদান করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধী ভাতা জনপ্রতি ৭০০ টাকায় উন্নীত করে এখাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক লাখ থেকে আট লাখ ২৫ হাজার জনে উন্নীত করা হয়েছে। ৮০ হাজার শিক্ষার্থীকে দেওয়া হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি। বর্তমানে ৮৬ হাজার ৪০০ এতিম শিশুকে জনপ্রতি মাসিক এক হাজার টাকা হারে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট দেওয়া হচ্ছে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে তাঁর সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন-২০১১’, ‘শিশু আইন-২০১৩’, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’, ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য ‘নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩’ ও ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সব ভাতাভোগী যাতে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ঘরে বসে ভাতা পেতে পারে, সে লক্ষ্যে তাঁর সরকার ক্যাশ ইনফরমেশন ট্রান্সফার মডার্নাইজেশন (সিটিএম) প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এর উপকারভোগীরা ভাতা পাবেন।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’, ‘বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’ এবং ‘চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন’ শীর্ষক তিনটি কার্যক্রম তাঁর সরকার বাস্তবায়ন করছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা দিতে ৪১৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসাপাতালে সমাজসেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
শিশু-কিশোরদের উন্নয়ন ও কল্যাণে আমাদের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশব্যাপী ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবারের কার্যক্রম চলছে। ছয় বিভাগে ছয়টি ছোটমণি নিবাস (বেবি হোম), একটি দিবাকালীন শিশুযত্ন কেন্দ্র, তিনটি দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ছয় বিভাগে ছয়টি এতিম ও প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। ১২টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাধ্যমে পথশিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, বিপদাপন্ন শিশুকে পুনর্বাসনসহ পরিবারে একীভূত করার জন্য ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি)’ শীর্ষক প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো পাঁচ বছরের জন্য অনুমোদন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি শিশু পরিবারগুলোর পুরাতন ভবনসমূহ ভেঙে নতুনভাবে ডরমেটরি ভবন তৈরি করা হচ্ছে। জয়পুরহাটে নির্মাণ করা হবে নতুন কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র।’
প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ ৪১ হাজার প্রতিবন্ধীকে শনাক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা অনলাইনেও প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছি। এসব তথ্য সংরক্ষণের জন্য ‘ডিজ্যাবিলিটি ইনফর্মেশন সিস্টেম’ (ডিআইএস) সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করছি।”
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়নের তাঁর সরকার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা সব সমাজিক নিরাপত্তা সেবাকে ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ৬৪ জেলায় সোশ্যাল সার্ভিসেস কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পও একনেকে অনুমোদন করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২২টি জেলায় অবিলম্বে এ কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ শুরু হবে।’ তিনি বলেন, ‘জাতির পিতাই আমাদের এই জায়গা দিয়ে যান যেটা আমরা এখন কাজে লাগাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী পরে অনুষ্ঠানস্থল থেকে ভিডিও কনফারেন্সর মাধ্যমে আগারগাঁওয়ে চার দিনব্যাপী জাতীয় সমাজসেবা মেলার ও উদ্বোধন করেন এবং দেশবাসীকেও এ সময় প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
আলোচনা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন