ব্যবস্থাপনার অভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ই-বর্জ্য
সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বাতিল ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে সৃষ্ট বর্জ্য বা ই-বর্জ্য। এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো বিধি-বিধান নেই। দীর্ঘদিন ধরে একটি খসড়া বিধিমালা করার উদ্যোগ থাকলেও তা চূড়ান্ত হচ্ছে না।
ই-বর্জ্য হচ্ছে সব ধরনের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য বা অংশবিশেষ বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাদ পড়েছে বা ভাঙা বর্জ্য যা অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ফেলে দেয়া হয়।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং তথ্য-প্রযুক্তির ওপর সরকার জোর দেয়ায় বাংলাদেশে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো কাঠামো নেই। মানুষের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা কম। বলতে গেলে, সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ই-বর্জ্য যে যার মতো ব্যবস্থাপনা করছে। এসব কারণে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে ই-বর্জ্য।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ই-বর্জ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বিষাক্ত উপাদান যেমন সীসা, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, বেরেলিয়াম ইত্যাদি থাকে। এসব বিষাক্ত বস্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, ব্রেইন, হার্ট ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইকো সিস্টেম নষ্ট করে। ই-পণ্যসামগ্রী ব্যবহারের ক্রম ঊর্ধ্বমুখিতায় ই-বর্জ্যের পরিমাণ ও ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে একটি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালার খসড়া করা হয়। কিন্তু এরপর আর এটি এগোয়নি। চলতি বছর এপ্রিলে ‘ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য হতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৭’ এর খসড়া করেছে সরকার। খসড়ার বিষয়ে মতামত নিতে তা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। এখনও এটি চূড়ান্ত করা হয়নি।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ই-বর্জ্য একটি নতুন বিষয়। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সরকার জোর দিচ্ছে। সবক্ষেত্রে কাভার করতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালা থাকলেও ই-বর্জ্যের জন্য আলাদা করে বিধিমালা করছি আমরা।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছি কিন্তু ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো বিধি-বিধান নেই। আশা করছি এ বিধিমালার মাধ্যমে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করা যাবে।’
বিধিমালাটি চূড়ান্ত করার বিষয়ে নুরুল করিম বলেন, খসড়া বিধিমালাটি আমরা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সবার মতামত চেয়েছি। মতামত পাওয়া পর আমাদের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করতে হবে। এরপর এটি চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে এখনও মতামত পাওয়া যায়নি।
পরিবেশ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে সাড়ে ১৩ কোটির বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রায় ১০ লাখ ল্যান্ড ফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ মোবাইল ফোন সেট আমদানি করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির তথা মোবাইল সেট, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে, একই সঙ্গে ই-বর্জ্যের পরিমাণও বেড়েছে।
সিটি করপোরেশনগুলো এখনও ই-বর্জ্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করার সক্ষমতাও নেই সিটি করপোরেশনগুলোর।
দেশে একমাত্র আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি লিমিটেড দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইদুর রহমান শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের কোনো নীতিমালা না থাকায় যে কেউ যেকোনোভাবে ই-বর্জ্যের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ করছে। সরকারের বিধি-বিধান ছাড়া এটা কন্ট্রোল করা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের একটি ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশে কাজ করছি। সার্কিট বোর্ডগুলো আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দেই। নারায়ণগঞ্জ কারখানায়ও ই-বর্জ্যের কিছু অংশের পুনঃচক্রায়ন আমরা করি।’
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, সার্কিট বোর্ড পুনঃচক্রায়ন করতে দেশেই প্ল্যান্ট স্থাপনের চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দেশের মধ্যে প্রচুর ই-বর্জ্য থাকলেও কোনো নিয়ম-কানুন বা পদ্ধতি না থাকায় আমরা পর্যাপ্ত বর্জ্য পাচ্ছি না। সবার ঘরেই বাতিল মোবাইল ফোন আছে কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তো এটা আমরা কিংবা যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছেন তাদের কাছে আসতে হবে।
ই-বর্জ্যের বিধিমালা একটি ভালো উদ্যোগ এবং বিধিমালার খসড়া সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে মতামত দিয়েছেন বলেও জানান সাইদুর রহমান শাহীন।
যা আছে খসড়া বিধিমালায়
‘ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য হতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৭’ এর খসড়ায় পণ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্বে বলা হয়েছে, ইলেক্ট্রনিক পণ্য বা যন্ত্রপাতি বিক্রির সময় প্রত্যেক প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের ওপর একটি হারে (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) অর্থ জামানত হিসেবে রাখবে। ই-পণ্য মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বা ব্যবহার শেষে ফেরত দেয়ার সময় বিক্রেতা জামানতের অর্থ প্রচলিত হারে সুদ বা মুনাফাসহ ফেরত দেবে।
প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব অনুমোদনের সময় ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে সরকার।
খসড়া বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী, ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মেরামতকারী, সংগ্রহ কেন্দ্র, ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় ব্যবহারকারীর/প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা, চূর্ণকারী ও পুনঃব্যবহারোপযোগীকারীর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’ এর ১৫ (২) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে দুই থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে বলে খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ভোক্তাকে নিবন্ধিত ব্যবসায়ী বা সংগ্রহ কেন্দ্রে ই-বর্জ্য জমা দিতে হবে। ভোক্তারা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আইনে নির্ধারিত জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে।
ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, সংগ্রহ কেন্দ্র, পরিবহনকারী, চূর্ণকারী, মেরামতকারী ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারীকে দায়িত্ব অনুযায়ী পরিবেশগত বা জনস্বাস্থ্যের যেকোনো ক্ষতির জন্য দায়ী করা হবে। এক্ষেত্রে তাদের নিজ অর্থে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বা ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবেশগত উপাদান পুনরুদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন